অরিজিৎ রায়ের কবিতা


অরিজিৎ রায়।
বাড়ি বাদুড়িয়া থানার অন্তর্গত ভোজপাড়া গ্রামে। বসিরহাট কলেজ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মাস্টার্স  ।  কবিতা লেখেন নিজস্ব মার্জিত রূপে , আবেগ বর্জিত ঝরঝরে ভাষায়।
জিরো বাউন্ডারির একক উদযাপন বিভাগে থাকছে কবির একগুচ্ছ কবিতা

 ১: ইতিহাসে‌র জন্ম

তুমুল বৃষ্টি। চারদিকে জলের কোলাহল।
বাড়ির পিছনের জঙ্গলে তখন হুলুস্থুল কাণ্ড।
জলের তোড়ে ভেসে যাচ্ছে পিঁপড়েদের ঘরবাড়ি
কে কোথায় ছিটকে গেছে জানা নেই।
এর‌ই মধ্যে জনাকতক মধ‍্যবয়সী ভীরু পিঁপড়ে
পুরুষ্টু এক পাতার উপর বসে বিন্দাস পৌঁছে গেল
বাগানের পূর্বদিকের ভিজে ঢিবিটার উপর।

ওই ঢিবিটাকে একটি রাষ্ট্র ভাবা হোক
পিঁপড়েরা জনগণ, শাসক আপাতত নেই।
প্রথমত ওদের খাদ্য প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত ওরা এরপর ঘর বানাবে।
পোশাকের যেহেতু প্রয়োজন ছিল না কোনোকালে অত‌এব তৃতীয়ত ওরা সংগমে মাতবে...
এভাবে বংশবিস্তার হয়ে রাষ্ট্র চৌহদ্দি বাড়াবে।

এখন, একটি রাষ্ট্র জন্ম নেওয়ার পর
তাদের ইতিহাস প্রয়োজন;
কীভাবে অথৈ বিপদের দিনে
জনাকতক জাতীয় বীর মূর্ত হয়ে গড়ে তুললো
এই রাষ্ট্র, তার গালভরা
মিথ্যে বীরত্ব নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস লেখা হবে
রাষ্ট্রীয় আতিথেয়তা‌য়, প্রবল বিক্রমে।

কেবল বাদ চলে যাবে বিপদে স্বার্থপর হ‌ওয়া
জনাকতক মধ্যবয়সী কাপুরুষ পিঁপড়ের হৃদয়।


২: মুহূর্ত


হয়তো ঠিক এই মুহূর্তে তুমি আমার কথা ভাবছ
রাজ‍্যের বিষণ্ণতা জড়ো হয়েছে তোমার মুখে,
বৃষ্টির কিছুটা ছোঁয়াচ তোমার কপালে আঁকছে বিন্দু
এবং এই ডুবন্ত সন্ধ্যায় হয়তো ঠিক এই মুহূর্তে
তোমার উঠোনে বসেছে সাময়িক কোলাহল

হয়তো ঠিক এই মুহূর্তে তুমি অন‍্য কিছু ভাবছ
পড়ার টেবিলে আধো হাত রেখে আনমনে আঁকছ
একটি সমুদ্র, দুটো জাহাজ, প্রচণ্ড ঝড় এবং আকুল অন্ধকার

কিংবা ঠিক এই মুহূর্তে‌ তুমি হয়তো হেসে উঠেছ উচ্চাঙ্গে
গোপনে পর্দার ভিতর তারপর লজ্জিত সরে গেছ
বিব্রত কোলাহল থেকে;

হয়তো ঠিক এখন‌ই তুমি
ভিড় থেকে সরে যেতে যেতে আমার কথাই ভাবছ


৩: কুঠুরি আর মুখাবয়ব


এই তো অগোছালো আমি;
মৃত্তিকা‌র অন্দরমহল অপেক্ষায়।
সংসারে আবর্জনা‌র মতো কিছুটা প্রেম
ছড়িয়ে প'ড়ে আছে
আমাকে কুড়োতে দিও না হে মানুষ
আমার কোনো রাধা নেই; চাইওনি কখনও।

নদীতে শিশুর মতো বিহ্বল নেমে যাই
ঘোলা জল ঋতুর বেশ ধরে
অনর্থক কথাগুলো তোমাকে শোনাব অথচ
তুমি ব'লে তোমার কোনো মুখাবয়ব নেই
আমার কোনো প্রেমিকা নেই; চাইওনি কখনও।

ফাঁকা ঘরে শিশুটির গালে চড় বসিয়েছি
শিশুটি কাঁদুক; তারপর শ্যাওলায় ভরে উঠুক ঘর
আমার কোনো বালিকা নেই; চেয়েছিলাম যদিও।

এই তো আবর্জনা‌র মতো আমি
কিছুদিন অদ্ভুত বেঁচে আছি মৃত্তিকার উপর
মাটির কুঠুরি অপেক্ষারত, মাটির উপরে মুখাবয়ব।


৪ : সংস্কার


এখন রাত বারোটায় আমি মৃদু ভয়ে বাইরে এলাম
ভূতেরা কোথাও নেই, তবুও ওই ব‌ই থেকে
ভয়েরা বেরিয়ে আমায় ধরেছে; আমি যে এখন কী করি

জ‍্যোৎস্নায় কলাগাছটাও ভূতের মতো বসে
যেন ঘোমটা দেওয়া রায় বাড়ির কোনো ব‌উ
আমি যেই এগুতে যাব, অমনি আমার হৃদয় গেল বেঁকে
সংস্কার বড়ো বিদঘুটে, সে বলল ফিরে চ; চোখ সরাসনি যেন।

আমি ফিরে চললাম। পড়ে র‌ইল ভরাট জ‍্যোৎস্না
আলুথালু মৃত্তিকার চাদর, বহুদিনের টিনের কৌটো
আর আমার বহুবার এভাবেই না দেখা
শিমুল গাছের মাথার উপর টাঙানো
দুর্ভিক্ষ রঙা চাঁদ; বড়ো নিঃশব্দ এক চাঁদ।


৫ : অপ্রকৃতিস্থ


এই মুহূর্তে আমার কোনো শব্দবিন‍্যাস নেই
মনে হচ্ছে যেন পাহাড় থেকে কয়েকশো ফুট
খাদের অতলে গভীর গুমোট বসে আছি;
এখানে তবুও তোমায় কীভাবে পাব ভাবছি

কানের পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে বিমান, মাছি
রক্তের হৃদয়ে রাখা বীজাণুর মতো তবু
একাকী প্রত‍্যেক মুহূর্ত তীব্র ভর্ৎসন জানাচ্ছে;
নিজের চৌহদ্দি জুড়ে মানুষ ভরে না কেন!

ইচ্ছে‌র নিগূঢ় তত্ত্ব তবু যদি বুঝত এখন কেউ
সে কি আসত না আমার প্রকাণ্ড এই মাদকে!
যে আদল রেখেছিলাম রাস্তায়, আহারে আজ
এই নিবিষ্ট মহাশূন্য দিনে মনে পড়ছে তাকেও

তীক্ষ্ণ অসংগত সুখে সুন্দর মুখশ্রী গেলে বেঁকে
আমাদের মানব ভ্রূণ হেসেছে কেঁদেছে ময়দানে;
এখন কীভাবে আমি তাকাব ঘোড়ার অভিঘাতে!
এই ভিড় জ‍্যোৎস্না‌য় অন্তরিত রোদ কেন তুমি?

কয়েকটি পতঙ্গ উড়ে গেল চোখের দু'পাশে
তারপর আরও কিছু অনর্থক উদযাপন শেষে
নিজের চৌহদ্দি খুঁজে আধটু মানুষ‌ না পেয়ে
উদভ্রান্ত অসংলগ্ন নদীর তীরে যাপন গেড়েছি

Comments

Popular posts from this blog

দেবীপ্রসাদ বটব্যাল এর কবিতা

শ্যামল সরকারের কবিতা

শম্পা সামন্তর কবিতা