সাবিয়া খাতুনের কবিতা


পুরুলিয়ার এক গ্রামে থাকেন  , এখানকার একটা সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পড়ান এবং বালার্ক নামে একটি সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদনার কাজ করেন । ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ. পাশ করেছেন। তরুণ এই কবি লেখেন প্রতিবাদের ভাষা , অত্যন্ত স্পষ্ট ভঙ্গিমায় ।

আজ জিরো বাউন্ডারির একক উদযাপন বিভাগে থাকছে কবির একগুচ্ছ করোনা পরিস্থিতি নিয়ে  কবিতা ।

 করোনা ডাইরি -১

তোর জন্মদিন আর কটা দিন পরেই
আমি বলেছিলাম শহরের নামী কেকের দোকানে কেক অর্ডার করব
তুই বলেছিলি "জানিস আমাদের দেশ ক্ষুধাসূচকে ১০২ নাম্বারে"
বলেছিলি,"যেখানে মানুষ দুবেলা দুমুঠো মোটা চালের ভাতই পায় না রোজ,সেখানে জন্মদিনে এত টাকা খরচ করে কেক,বিলাসিতা"
আমি কাঁদো কাঁদো চোখে বলেছিলাম,"কিন্তু আমি তোর জন্মদিনে কিছুই করব না?আমার ইচ্ছে করে না?
তুই বললি "অবশ্যই করবি,আমাকে আমাকে একটা তিনটাকা দামের ইউজ অ্যান্ড থ্রো পেন দিবি,আমি তোকে নিয়ে কবিতা লিখবো,তুই তো আবার খাতায় না লিখলে পছন্দ করিস না,হাতের লেখা চিঠিই তোর বেশী পছন্দের,হোয়াটসঅ্যাপের থেকে"
আর তোকে কিছু খাওয়াব না ওইদিন?
তুই বললি "হ্যাঁ অবশ্যই,জানিস তো ওই বাসস্ট্যান্ডের সামনে জেঠুর অনেক বয়স,ঝালমুড়ি নিয়ে বসেন রোজ,বিক্রি হয় না খুব একটা,ওনার কাছে দুজনে ঝালমুড়ি কিনবো"
তখন তো জানতাম না,তোর আর আমার দেখাটাই হবে না তোর জন্মদিনে,
দুজনেই আজ গৃহবন্দী
আর ওই জেঠুও তার ঝালমুড়ি নিয়ে বেরোতে পারেননি,বেরোলে তবুও তো কিছু বিক্রি হত...
সেই টোটোর দাদা,তার বাড়িতেও আজ কী অবস্থা জানি না....
আর যদি তারা বেরিয়েও পড়েন তবুও তো মহামারী ধরবে,তাই 'না বেরোনোটা দরকার'
কিন্তু পাকস্থলী কি ভাইরাস মানে?
বল মানে?


 করোনা ডাইরি-২

মনে পড়ে খাঁচার ভেতরে পাখিগুলোকে বন্ধ করে রেখেছিলে?
খাবার দিয়েছিলে,জল দিয়েছিলে
তা তুমিও তো পাচ্ছো খাদ্য আর জল
বাইরে যাবার জন্য হাঁসফাঁস করো কেন তবে?
মনে পড়ে?বাঘ, সিংহ,জিরাফ,গরিলা
সব্বাইকে চিড়িয়াখানায় বন্দি করেছিলে?এখন আকাশ দেখবার জন্য অস্থির কেন?
মনে পড়ে মেয়েদের বাড়ির চৌকাঠ মাড়াতে দাওনি?
বিকেলে নদীর পাড়ে,খোলা মাঠে বসতে যেতে দাওনি?
রান্না আর বাসনমাজায়,তাদের যাপন থমকে দিয়েছিলে?
এখন নিজেরাও একটু বন্দিত্বের স্বাদ নাও
যে বন্দিত্ব হাজার বছরের হারেমে
যে বন্দিত্ব সাম্প্রতিক ডিটেনশন ক্যাম্পে
যে বন্দিত্ব পর্দাপ্রথায়
যে বন্দিত্ব অসূর্যম্পশ্যায়
তার যন্ত্রণা কোনোদিন অনুভব করেছিলে?
অনুভব করেছিলে তাদেরও ইচ্ছে করে রাতের অন্ধকারে পৃথিবীর শোভা দেখতে
চাঁদনী রাতে একা একা রাস্তায় কিছুটা হেঁটে আসতে...
কিংবা নিছক রোমান্টিসিজম নয়
জীবিকার প্রয়োজনেও রাত্রি হয়
কিন্তু হায়েনার ভয়ে
রাস্তায় বেরোতে কুঁকড়ে যায়।
প্রকৃতির বিচারে আজ যদি সুযোগ পেয়েছো
তবে আত্মশুদ্ধির পথ বেছে নাও
নইলে আরো কত উল্টোরথ গড়িয়ে আসবে.....


 করোনা ডাইরি-৫

জানিস এখন আর মেঘ নেই
আকাশটা ঝলমলে নীল
ছাদে দাঁড়ালেই কত বক
দুষ্টু ছেলে ঢিল ছুঁড়লে উড়ে পালায়
আমি আকাশ দেখি,বক দেখি
মাঝে মাঝে তোর কথা মনে পড়ে
না না মনে করতে চাই না তবুও
আসলে অসুখ তো চারিদিকে
কী জানি কেমন আছিস দুর্দিনে
মহামারী কেবল আর থেমে নেই
ভাইরাস তো বাতাসে
ভাইরাস মনে,ভাইরাস প্রতিদিন
কত যুগ,কত পথ...
রূপ বদলায়,গঠনও
যতই বসুন্ধরা বৈঠক হোক
আটকানো কঠিন
এত মাথা ব্যথার দরকার ছিল না
কিন্তু চারিপাশ বিষাক্ত,তুইও
তবুও ঔষধ খেতে হয়
কিন্তু খুব তেতো
তাই খেতেই চায় না
ঔষধ দিতে এলেও শিকার হয়।


 করোনা ডাইরি-৬

আকাশ দেখতে দাওনি
পাখি দেখতে দাওনি
রেখেছিলে 'অমল' করে
ডাকঘরের জানালাটা অন্তত খোলা ছিল
কিন্তু আমারবেলা ঘুপচি ঘর
ওখান থেকে 'ছেলের দল' দল দেখা যায় না
'সুধাকে' দেখা যায় না
কে শোনাবে আমাকে সাতভাই চম্পার গল্প?
আসলে তোমরা বলো আমার ভীষণ অসুখ
কিন্তু আমি জানি আমার জন্মটাই রোগ
আমি জানি জীবাণু তোমাদের সমাজে
তাই আমার বাঁচাকে অসুস্থতা বলো
অমলের তবুও বন্দুক ছিল
আমার তো তাও নেই
আসলে কি জানো আমাকে বন্দুক,সৈন্য  কিনে দেয়নি কেউ।
একটা চীনে-পুতুল দিয়েছিল
কিন্তু আমি পুতুল খেলি না
আমি চাই এরোপ্লেন
আমি তো কল্পনা চাওলা হব
হাউই চড়ে চলে যাব ঐ মহাকাশে
চুপিচুপি তোমাদের বলে রাখি
আমি  কিন্তু আর ফিরব না।
কেন ফিরে আসব বলো?
এলেই তো 'ডাকঘরে' বন্দি করবে।


 করোনা ডাইরি-৮

তোমাকে নিয়েই কবিতার হাতেখড়ি
ডাইরির পাতা ভরে উঠত একদিন
কেন্দ্রবিন্দু ছিলে তুমি
কত কবিতা,কত চিঠিতে ভরে যেত অঙ্কের খাতা
না না চিঠিগুলো কোনো ডাকবাক্সে দিইনি
কোনোদিন তোমার হাতেও ধরিয়ে দিইনি
ওগুলো ছিল আমার অভিমানের শব্দরূপ
প্রচণ্ড অভিমান হলেই শুধু ওরা কলমের ডগায় ঝরে পড়ত
তুমি তো জানোই কত দিন বছর পেরিয়ে গেছিল
সব সাক্ষী তুমি...
একদিন তুমিও তিক্ত হয়ে উঠেছিলে
হয়ত বিরক্তও...
তারপর রাজপথে হঠাৎ দেখা হলেও এড়িয়ে চলি
যখন তুমি বাসের অপেক্ষায়
ইচ্ছে করেই এক বাসে উঠি না
দেরি হলেও...
সময়ের অপচয়েও রাজী কিন্তু তোমার অবহেলা...
তারপর বহুবছর কেটে গেল
এখনো সেই একই জায়গায় সন্ধ্যা নামে
নাম্বার ডায়াল করি অবশ্য মাঝে মাঝে
কিন্তু ওই সিমকার্ড চিরকালের জন্য বন্ধ
নতুনটা আমি জোগাড় করতেই পারি
কিন্তু বড্ড অপমানিত বোধ করি
আসলে যা স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ থেকে আসে না
তার ভার বওয়া বড় দায়...
যে বোঝা চাপিয়েছিলাম....
যদিও তার আর প্রয়োজন নেই
তবুও যদি তুমি সেই ভয়ে কুঁকড়ে যাও
তাই দুরত্বই ভালো...দূরত্ব...
দেখছো না এখন কেমন একটা বৈজ্ঞানিক কথা বাজারে এসেছে 'সোস্যাল ডিসট্যান্সিং'...

সাবিয়া খাতুন
০২/০৪/২০২০

Comments

  1. খুব সুন্দর । প্রতিটা কবিতাই ভালো লেগেছে। সুন্দর এবং প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরা হয়েছে সব কটা কবিতা।

    ReplyDelete
  2. বেশ সহজ সুন্দর ভাষা।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

দেবীপ্রসাদ বটব্যাল এর কবিতা

শ্যামল সরকারের কবিতা

শম্পা সামন্তর কবিতা