সবর্ণা চট্যোপাধ্যায়ের কবিতা
খুব দ্রুত উঠে আসা এই সময়ের এক মুখ সবর্না চট্যোপাধ্যায় । তরুণ এই কবির কবিতার মধ্যে শব্দ চয়নের দারুণ নিজস্বতা আছে এবং সেই সঙ্গে কবিতার মধ্যে থাকে অদ্ভুত মায়াবী কুহেলিকা , অথচ শব্দ ব্যবহার তেমনই সাবলীল । প্রায় সমস্ত প্রথম শ্রেণীর পত্রিকায় লিখছেন কবি । 2018 সালে সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত তাঁর কাব্যগ্রন্থের নাম -চারদেওয়ালি চুপকথারা । জিরো বাউন্ডারি গ্রুপের সাথে জড়িয়ে থাকা এই কবি তাঁর লেখাকে দিন দিন ক্ষুরধার করে তুলছেন।
আজ রইল কবির একগুচ্ছ কবিতা । পাঠকের ভালো লাগবে অবশ্যই।
১: একটা ভিডিও কলিং
বিষণ্নতার নীচে টলমল করছে জল
তখনই ফোনটা এল।
হঠাৎ ছিনিয়ে নিয়ে গেলে ইহলোক!
দুমড়ানো বাক্সের ভেতর রাখা কাগজ
উই ধরা ভ্যাপসা দেয়াল
পুরোনো হয়ে যাওয়ার যে কী ভীষন এক গন্ধ আছে,
টের পাচ্ছি চুপিচুপি।
ফোনটা ঢুকে পড়ল আলো নিয়ে।
ধুয়ে মুছে যাচ্ছে ধুলো।
ভেসে যাচ্ছে ঢেউ
ঠোঁট ছুঁয়ে আসা এক একটা শব্দ
উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে নিশ্চিত জ্যোৎস্নার কাছে।
কোন ইহলোক নেই। অপরাধ নেই।
দুজনে শুধু সাঁতরে চলেছি দিগভ্রান্তের মতো
খুলে যাচ্ছে একটা করে লোহার শেকল
একএকটা বন্ধ দরজা আর
আমরা পেরিয়ে যাচ্ছি
কিশোরবেলার মাঠ!
২: প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য৫
বলে চলেছ অনর্গল, নিজেদের লুকোচুরি।
দড়ি টানাটানি খেলা!
একবারও কি তাকিয়েছিলে আমার দু'চোখে?
স্থির হয়ে ছিল অশ্রুপাত। মানতে পারছি না কিছুতেই।
কিছুতেই না।
অথচ আমরা দাবীহীন।
তবুও কেন হিংস্র হতে চাওয়া!
তবু কেন তোমাকে নিজের ভাবলে
সূর্য ওঠে ঠিক। অস্ত যায় ।
নাহলে বড় জটিল। কঠিন সময়।
বরফের মতো শীতল হয়ে আসে হাত
বুকের ভেতর ঠান্ডা জলস্রোত
বলে চলেছ অনর্গল, তোমাদের দেওয়া নেওয়া
আর আমি ভাবছি
'কিভাবে আমরা মহাকাশ পারি দিয়েছি বারবার,
এক একটা দীর্ঘচুম্বনে!'
৩: আমার প্রেমিকা
চারদিকে ঘিরে ধরছে ধোঁয়া।
শহরটা মিলিয়ে যাচ্ছে কর্পুরের মতো।
ভেঙে যাচ্ছে দেওয়াল।
রাস্তায় কাচ। পা দিতে ভয় হয়।
সমস্ত নস্টালজিয়ায় তাজা রক্তের দাগ!
আমার প্রেমিকা তাই ছেড়ে চলে গেছে বাঁচার তাগিদে।
সে শ্বাস নিতে পারছিল না আর। তবুও
হাতে মদের গ্লাস দেখে ধর্ষণ করেছিল সমাজ।
আমি তাকে বারবার
শিখিয়েছিলাম 'রক্ষনশীলতা আসলে মেয়েলি পোশাক '।
শোনেনি। তার ফুরফুরে ডানায় তাজা বাতাস
রাতের ডিস্কো তাকে নাড়া দিতো ঈশ্বরের মতো।
বুকের ভেতর ছিল উদ্দাম ঢেউ।
সংস্কার শেখানোর নামে চুলের মুঠি ধরেছি বহুবার।
বহুবার তলপেটে পা রেখে গেঁথে দিয়েছি গরম শিক।
তবু আটকাতে পারিনি।
সে উড়েছে। উড়তে উড়তে এক এক করে
সে ফেলে গেছে
রক্তমাখা ডানার সমস্ত পালক…
মৃত্যু না আসা পর্যন্ত !
৪: সমুদ্র
ঢেউ উঠেছিল। ভেসে গেল ডিঙি
তবু নিস্তার নেই!
কোথায় ঠিকানা? কোথায় শেষ আশ্রয়?
এক এক করে খসে পড়ছে ইঁট
পুরোনো পাঁচিলের নোনা গন্ধ তবু
তা আমার
শুধু আমার!
তখন উত্তাল সাগর
জিভের ডগায় বিষ
সারা শরীর ডুবে যাচ্ছে জলে
চোখের ভেতর থেকে উড়ে গেল শঙ্খচিল।
তোমার চোখে যেন আকাশ!
মুখের ভেতর হুড়হুড় করে ঢুকছে নোনা জল
এক জন্ম ও মৃত্যুর মাঝে হু হু শূন্যতা
তুমি হাত ধরে নিয়ে চলেছ
অতলের খোঁজে!
৫: ঘুম আসে না আজকাল
আজকাল ঘুম আসে না। চোখ
বুজলে ধোঁয়া ধোঁয়া দেখি।
চারদিকে ছটফট করছে শব্দ
মৃত্যু হচ্ছে। মৃত্যু আর মৃত্যু।
ফেটে পড়ছে ক্ষোভ
তবু আজো বুঝিনা সব অভিযোগ নিভে
গেলে কেন ভালোবাসা চায় মানুষ?
এখন আর ঘুম আসে না। তোমায় উলঙ্গ
দেখেছি বহুবার, রাস্তায় ছুটতে ছুটতে
চিৎকার করছো ' বাঁচাও'!
কেউ নেই অথচ দেখছে সবাই
আসলে তোমার ধর্ম বোঝার আগেই
ঠিক করে নিয়েছে তারা নৃশংস ছক।
দেখছে তবু মুখ খুলছে না।
জেগে আছে তবু জাগছে না।
ছটফট করছে শব্দ।
আমার নিঃশ্বাস ফুঁড়ে জন্ম নিচ্ছে চিৎকার
তবু যেন কেউ চেপে ধরছে মুখ,
গোঁগানির ভেতর ডুবে যাচ্ছে একটা শহর
শুধু মৃত্যু হচ্ছে মৃত্যু আর মৃত্যু!
৬: অ-সুখ
ঠোঁটে ঠোঁটে মিশে গেল বিষ
সারা শরীর আজ নীল
তোমাকে আগে এত সুন্দর দেখেনি কোনদিন।
যেন খোলা ছাদে, দু'হাতে বাতাস
এলোমেলো করে দিচ্ছে গোছানো চুল।
ছাড়াতে পারিনি। আটকে রেখেছিলে
যেমন চুম্বক আটকে রাখে লোহা
আমিও লাল হয়ে উঠেছি গনগনে আঁচে।
ঘামের গন্ধ, সাপের নিঃশ্বাস
খোলস ছাড়ছে সাদা শরীর
রক্ত গড়িয়ে আসছে ঠোঁটে
বেদানার রস ভেবে চেটে নিচ্ছো,
সমস্ত অ-সুখ!
৭: গুহাচিত্র
বঁটিতে এঁচোড় কাটতে কাটতে লুটিয়ে পড়ছে আঁচল
রাত আটটা তখন। সকালের কাজ মিটিয়ে রাখা।
তারপর বড়ছেলে বড়বৌ,
নটায় রাতের খাবার।
মায়ের সিরিয়াল শেষ হবে দশটায়।
একা একা দু'টো ভাত মেখে খাওয়া।
ঘুমের ভেতর জেগে ওঠে বর
চিরকাল একা থাকা। দুজনে যেন দুটো দ্বীপ।
কেউ কাউকে স্পর্শ করেনি কোনদিন
তবুও তিন ছেলে এক মেয়ে!
মেয়েদের বোবা হতে শিখিয়েছিল মা।
বাবা বিয়ে দিয়েছিল মা মরা মেয়েকে।
তারপর থেকে তোতলাতে শিখেছে শুধু!
সকাল হলে, একমাত্র রান্নাঘর।
ছোট ছেলে কচুশাক ভালোবাসে
মেজোছেলে মাংস
বড় ছেলে নিরামিষ খাবে আজ।
মেয়ে বলে গেছে, তিনজন তিনদিন চারবেলা!
বাড়ির দেয়ালে তেল হলুদ চুনকাম হয়।
মা হাতের ছাপ এঁকে চলে চল্লিশ বছর ধরে।
দেয়ালে দেয়ালে হায়ারোগ্লিফক
শুধু পাঠোদ্ধার হয়নি কোনদিন!
আজ রইল কবির একগুচ্ছ কবিতা । পাঠকের ভালো লাগবে অবশ্যই।
১: একটা ভিডিও কলিং
বিষণ্নতার নীচে টলমল করছে জল
তখনই ফোনটা এল।
হঠাৎ ছিনিয়ে নিয়ে গেলে ইহলোক!
দুমড়ানো বাক্সের ভেতর রাখা কাগজ
উই ধরা ভ্যাপসা দেয়াল
পুরোনো হয়ে যাওয়ার যে কী ভীষন এক গন্ধ আছে,
টের পাচ্ছি চুপিচুপি।
ফোনটা ঢুকে পড়ল আলো নিয়ে।
ধুয়ে মুছে যাচ্ছে ধুলো।
ভেসে যাচ্ছে ঢেউ
ঠোঁট ছুঁয়ে আসা এক একটা শব্দ
উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে নিশ্চিত জ্যোৎস্নার কাছে।
কোন ইহলোক নেই। অপরাধ নেই।
দুজনে শুধু সাঁতরে চলেছি দিগভ্রান্তের মতো
খুলে যাচ্ছে একটা করে লোহার শেকল
একএকটা বন্ধ দরজা আর
আমরা পেরিয়ে যাচ্ছি
কিশোরবেলার মাঠ!
২: প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য৫
বলে চলেছ অনর্গল, নিজেদের লুকোচুরি।
দড়ি টানাটানি খেলা!
একবারও কি তাকিয়েছিলে আমার দু'চোখে?
স্থির হয়ে ছিল অশ্রুপাত। মানতে পারছি না কিছুতেই।
কিছুতেই না।
অথচ আমরা দাবীহীন।
তবুও কেন হিংস্র হতে চাওয়া!
তবু কেন তোমাকে নিজের ভাবলে
সূর্য ওঠে ঠিক। অস্ত যায় ।
নাহলে বড় জটিল। কঠিন সময়।
বরফের মতো শীতল হয়ে আসে হাত
বুকের ভেতর ঠান্ডা জলস্রোত
বলে চলেছ অনর্গল, তোমাদের দেওয়া নেওয়া
আর আমি ভাবছি
'কিভাবে আমরা মহাকাশ পারি দিয়েছি বারবার,
এক একটা দীর্ঘচুম্বনে!'
৩: আমার প্রেমিকা
চারদিকে ঘিরে ধরছে ধোঁয়া।
শহরটা মিলিয়ে যাচ্ছে কর্পুরের মতো।
ভেঙে যাচ্ছে দেওয়াল।
রাস্তায় কাচ। পা দিতে ভয় হয়।
সমস্ত নস্টালজিয়ায় তাজা রক্তের দাগ!
আমার প্রেমিকা তাই ছেড়ে চলে গেছে বাঁচার তাগিদে।
সে শ্বাস নিতে পারছিল না আর। তবুও
হাতে মদের গ্লাস দেখে ধর্ষণ করেছিল সমাজ।
আমি তাকে বারবার
শিখিয়েছিলাম 'রক্ষনশীলতা আসলে মেয়েলি পোশাক '।
শোনেনি। তার ফুরফুরে ডানায় তাজা বাতাস
রাতের ডিস্কো তাকে নাড়া দিতো ঈশ্বরের মতো।
বুকের ভেতর ছিল উদ্দাম ঢেউ।
সংস্কার শেখানোর নামে চুলের মুঠি ধরেছি বহুবার।
বহুবার তলপেটে পা রেখে গেঁথে দিয়েছি গরম শিক।
তবু আটকাতে পারিনি।
সে উড়েছে। উড়তে উড়তে এক এক করে
সে ফেলে গেছে
রক্তমাখা ডানার সমস্ত পালক…
মৃত্যু না আসা পর্যন্ত !
৪: সমুদ্র
ঢেউ উঠেছিল। ভেসে গেল ডিঙি
তবু নিস্তার নেই!
কোথায় ঠিকানা? কোথায় শেষ আশ্রয়?
এক এক করে খসে পড়ছে ইঁট
পুরোনো পাঁচিলের নোনা গন্ধ তবু
তা আমার
শুধু আমার!
তখন উত্তাল সাগর
জিভের ডগায় বিষ
সারা শরীর ডুবে যাচ্ছে জলে
চোখের ভেতর থেকে উড়ে গেল শঙ্খচিল।
তোমার চোখে যেন আকাশ!
মুখের ভেতর হুড়হুড় করে ঢুকছে নোনা জল
এক জন্ম ও মৃত্যুর মাঝে হু হু শূন্যতা
তুমি হাত ধরে নিয়ে চলেছ
অতলের খোঁজে!
৫: ঘুম আসে না আজকাল
আজকাল ঘুম আসে না। চোখ
বুজলে ধোঁয়া ধোঁয়া দেখি।
চারদিকে ছটফট করছে শব্দ
মৃত্যু হচ্ছে। মৃত্যু আর মৃত্যু।
ফেটে পড়ছে ক্ষোভ
তবু আজো বুঝিনা সব অভিযোগ নিভে
গেলে কেন ভালোবাসা চায় মানুষ?
এখন আর ঘুম আসে না। তোমায় উলঙ্গ
দেখেছি বহুবার, রাস্তায় ছুটতে ছুটতে
চিৎকার করছো ' বাঁচাও'!
কেউ নেই অথচ দেখছে সবাই
আসলে তোমার ধর্ম বোঝার আগেই
ঠিক করে নিয়েছে তারা নৃশংস ছক।
দেখছে তবু মুখ খুলছে না।
জেগে আছে তবু জাগছে না।
ছটফট করছে শব্দ।
আমার নিঃশ্বাস ফুঁড়ে জন্ম নিচ্ছে চিৎকার
তবু যেন কেউ চেপে ধরছে মুখ,
গোঁগানির ভেতর ডুবে যাচ্ছে একটা শহর
শুধু মৃত্যু হচ্ছে মৃত্যু আর মৃত্যু!
৬: অ-সুখ
ঠোঁটে ঠোঁটে মিশে গেল বিষ
সারা শরীর আজ নীল
তোমাকে আগে এত সুন্দর দেখেনি কোনদিন।
যেন খোলা ছাদে, দু'হাতে বাতাস
এলোমেলো করে দিচ্ছে গোছানো চুল।
ছাড়াতে পারিনি। আটকে রেখেছিলে
যেমন চুম্বক আটকে রাখে লোহা
আমিও লাল হয়ে উঠেছি গনগনে আঁচে।
ঘামের গন্ধ, সাপের নিঃশ্বাস
খোলস ছাড়ছে সাদা শরীর
রক্ত গড়িয়ে আসছে ঠোঁটে
বেদানার রস ভেবে চেটে নিচ্ছো,
সমস্ত অ-সুখ!
৭: গুহাচিত্র
বঁটিতে এঁচোড় কাটতে কাটতে লুটিয়ে পড়ছে আঁচল
রাত আটটা তখন। সকালের কাজ মিটিয়ে রাখা।
তারপর বড়ছেলে বড়বৌ,
নটায় রাতের খাবার।
মায়ের সিরিয়াল শেষ হবে দশটায়।
একা একা দু'টো ভাত মেখে খাওয়া।
ঘুমের ভেতর জেগে ওঠে বর
চিরকাল একা থাকা। দুজনে যেন দুটো দ্বীপ।
কেউ কাউকে স্পর্শ করেনি কোনদিন
তবুও তিন ছেলে এক মেয়ে!
মেয়েদের বোবা হতে শিখিয়েছিল মা।
বাবা বিয়ে দিয়েছিল মা মরা মেয়েকে।
তারপর থেকে তোতলাতে শিখেছে শুধু!
সকাল হলে, একমাত্র রান্নাঘর।
ছোট ছেলে কচুশাক ভালোবাসে
মেজোছেলে মাংস
বড় ছেলে নিরামিষ খাবে আজ।
মেয়ে বলে গেছে, তিনজন তিনদিন চারবেলা!
বাড়ির দেয়ালে তেল হলুদ চুনকাম হয়।
মা হাতের ছাপ এঁকে চলে চল্লিশ বছর ধরে।
দেয়ালে দেয়ালে হায়ারোগ্লিফক
শুধু পাঠোদ্ধার হয়নি কোনদিন!
অনন্য
ReplyDeleteঝরঝরে ঝলমলে কবিতা, ভালো লাগলো।
ReplyDelete