অর্পিতা দাশগুপ্তর কবিতা

অর্পিতা দাশগুপ্ত থাকেন কলকাতায়। পেশায় গৃহিণী এবং সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগে  post graduate.
অর্পিতার লেখা বেশ শক্তিশালী।  ওর লেখায় মায়াবী আদিমতা লুকিয়ে থাকে যা তৈরি করে এক গহীন রহস্যময়তা।
আজ জিরো বাউন্ডারির একক উদযাপন বিভাগে থাকছে কবির একগুচ্ছ কবিতা।


১ : নার্সিসাস

ঠোঁট দেখলেই বুঝতে পারি
কখন ঠোকরাতে চাও
ইচ্ছে করে সরে আসি
কিন্তু লোভ হয়
বড় লোভ হয় নার্সিসাস !
বার বার রক্তাক্ত হতে হতেও
কি এক মোহাচ্ছন্নতায় .......

ঠোঁট দেখলে বুঝতে পারি
কখন নিজেকেই শেষ করে
দিতে চাও আদরে আদরে
বড় ঘৃণা হয় !
তবু কি বশ্যতায় তোমার
সামনে আয়না ধরে থাকি !

ঠোঁট দেখলে বুঝতে পারি
বিষে উন্মুখ হয়ে আছো আনখশির !
তবু কি অনিবার্যতায় .....
নার্সিসাস !
তোমার কাছেই চাই শেষ চুম্বন !


২ : অমানবী

আবছা দেখতে পাচ্ছি তোমার
বাড়িটার ভগ্ন দেহে বাসা বাঁধছে
এক ছায়ামানুষ
ঝুঁকে আসা
চিলেকোঠায় মাকড়সার ঝুলের
মত সে বিস্তার করছে নিজেকে  !

তোমার সিগারেট খাওয়ার ধরণ
থেকে সামান্য কুঁজো হয়ে
খবরের কাগজ কুড়িয়ে নেওয়া
সবই শিখে নিচ্ছে একে একে
শিখে নিচ্ছে মুদ্রাদোষ , পরকীয়া
প্রেম ও প্রেমহীনতার মধ্যে অবাধ
বিচরণ !

তুমিও টের পাচ্ছ এক প্রেতের আঙুল
সর্বদা বিলি কাটছে তোমার চুলে
একটু একটু করে
খুলে নিচ্ছে তোমার নির্মোক !

ওই প্রেত আমার প্রেরিত
তোমার জন্য আমি আত্মা
বিক্রি করে প্রেতসিদ্ধা হয়েছি
এতদিনে !

তোমার জন্যে এক ছায়াবাড়ি
গুছিয়েছি আমার পাড়ায়
তোমার জন্য আমি
অমানবী হয়ে গেছি
ঈশ্বরের চোখে !

৩ : রাইটার্স ব্লক

শব্দেরা ট্রেন বদল করে
কি রকম অন্য ভুবনে ছন্দ
কল্প অনুপ্রাস ,
পাতাল স্টেশনে
প্রলাপের মত বাজে
তিলক কামোদ
বোধহীন , শব্দহীন , অন্তহীন
প্রসব বেদনা
কানা মথ ঢুকে পরে
নীল গহ্বরে , শব্দের নীল
নীল মিরাজ
নির্বাক ছবিওয়ালা মাথা ভর্তি
গ্রাফিক কন্টেন্ট নিয়ে
ওয়ান্ডারল্যান্ডে নাচে ভুতের
মতন
হুসেনের সরস্বতী অবিকল
মাধুরীর মত হাসে
পাতাল স্টেশনের টাইম টেবিলে
বদ্ধ উন্মাদের
মত ডিপার্চার টাইম খোঁজে
বিপন্ন পেন ফাইটার

৪ : টিপ

একটি টিপে ধরে যায়
গোটা চৈত্রমাস  !
মিলুর ফেলে যাওয়া
সবটুকু আঁচ ! ঝুটমুট
চৈতি আকুল হলে
চন্দ্রমুখীর দুই ভুরু
তুমি শুধু খুঁজেছিলে
চুমুকে চুমুকে সর্বনাশ !

এলিয়ে রেখেছি রাত
রাত হলে ত্রিনয়ন জ্বলে ,
রাত হলে এঁটোটিপ ফুলে
ওঠে ছোবলে ছোবলে  !
মধুমাস পুড়ে গেলে
এক বিন্দু মন পড়ে থাকে
মিলুর নষ্ট টিপে
আমার চৈত্রমাস
আয়নার মত লেগে থাকে |


৫ : অন্য ওথেলো

চাক চাক অন্ধকার ছুঁড়ে
দিচ্ছ ইজেলের দিকে
ঘষে ঘষে মুছে ফেলছ পেন্টিং এর
পেলব সকাল
দাঁড়াচ্ছ জানলায় অতৃপ্ত প্রেতের
মতন
একবারও দেখছনা চিত্রার্পিত হয়ে
আছে রাত
নির্বাক মেঘমালা জমে আছে রক্তাভ
চোখে
বিস্ফারিত তারারা দেখছে অন্য এক
ক্লাসিক ট্র্যাজেডি
 রুমাল রহস্য কিংবা অন্য কোনও
দীর্ঘ সলিলকি !

তোমার অন্ধ আঙুল এবার আঁকুক
দেয়ালি পোকায় ঠাসা ত্যক্ত কেবিন ,
যৌন হতাশার  মত ধূসর বনস্থলী ,
কালো প্রজাপতি !
ফ্যাকাসে লাল নদীর
নির্জনতম কোনও ঘাট
সেখানে শুইয়ে দাও আমার নিথর
দেহ ,
ঘাতক রুমাল আর ডেসডিমোনার
মাঝামাঝি !

৬ : আধিদৈবিক

পাগলের মাথার থেকে মাথার ভিতরে
থাকা ধোঁযাশার  থেকে ,
স্বমেহনে রিক্ত দুটো ওলটানো
চোখ থেকে বের হয়ে আসেন
মাতঙ্গী ! বীজমন্ত্র দেন !
পাগলীর জটায় বাঁধা
একগঙ্গা পবিত্র বিস্মরণ !
পাগল ও পাগলির তুমুল
মিলনে গর্বাচৌথের মেঘ
লজ্জায় ঢেকে দেয় এয়োতী
চাঁদের শ্রীমুখ
তামসী নদীর ঘাটে সুডৌল
উলঙ্গ পেটে মহাজাগতিক
ছাই মাখেন গর্ভিণী
সস্নেহে প্রসব করেন যাঁকে
লোকে তাকে নরাসুর বলে
কেউ কেউ মহাকাল বলে
দর্শন মাত্র তাঁর
অঘোরীর সিদ্ধিলাভ হয় !
কৃষ্ণা দ্বাদশীর রাতে
পাগলের ছদ্মবেশ
খুলে নেন মাতঙ্গী নিজে
যোগী ও যোগীনির পূত
গর্ভে ও বীজে
কালপুরুষের জন্ম হয় |

৭  : জীবনানন্দ

বড় অন্তরঙ্গ হয়ে বসেছি তোমার কাছে
যেভাবে মাঘের রাতে বুকে টেনে নিই লেপ
যেভাবে আঁকড়ে ধরি দয়িতকে সঙ্গমশেষে

মলিন পেপারব্যাকে আলোআঁধারির গ্রাম
মনখারাপের চালে বসে আছে বিধুর সম্রাট !
জলসিঁড়িটিরে বোলো আমিও এসেছি
হয়ত ছিলাম ঘাসফুল হয়ে কিংবা জলফড়িং

মালয় সাগর সাঁতরিয়ে
এসেছি আবার কত জন্মের পর
এ শহরে

দেখেছি মানুষের মুখে থরে থরে ইঁট
জানলায় জানলায় অসহ্য আলো
উড়ালপুলের অষ্টপাশে সহস্র চাকার
গর্জন !

এ শহরে ফিরে এসে নাটোরের বনলতা সেন
বললেন কোথায় কাঁঠালছায়া ! কলমির ঘ্রাণ ?
কোথায় ক্ষুধিত কবি , ছায়া নীড়ে কে গাহিবে
জীবনের গান ?

হয়ত এসেছ রাত হয়ে
এশহরে ঘুমায় না যারা তারা চেনে সুদর্শন
তোমার !

তুমি ফেরো , আমরাও ফিরি বারে বারে
ধানসিঁড়িটির টানে , নবান্নের ঘ্রাণে
এই বাঙলায়  .......

অর্পিতা দাশগুপ্ত

Comments

  1. অনন্য সুন্দর ভাষা ও কাব্যময়তা। এককথায় অসাধারণ।

    ReplyDelete
  2. দারুন লাগলো। আরো অনেক চাই।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

দেবীপ্রসাদ বটব্যাল এর কবিতা

শ্যামল সরকারের কবিতা

শম্পা সামন্তর কবিতা