হরিৎ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতা
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
জন্ম ১৯৬৭ সালের ২ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার ধনিয়াখালি গ্রামে। লেখালিখির শুরু খুব ছোটবেলা থেকেই। পেশায় গৃহশিক্ষক হলেও সাহিত্যই চব্বিশ ঘণ্টার ধ্যানজ্ঞান।
আজ জিরো বাউন্ডারির একক উদযাপন বিভাগে থাকছে কবির একই শিরোনামে একগুচ্ছ কবিতা
মধ্যরাতের সংলাপ
( নয় )
কত যে প্রশ্ন করি, কোথাও তো একটা দাঁড়াতেই হয়, ঠিক সেখান থেকেই জেনে নেওয়া নিজের অবস্থান, কতটা হেঁটেছি, বাড়ির চৌকাঠে দাঁড়িয়ে যে প্রস্তুতি নিয়েছি তার ঠিক কতটা কাজে লাগাতে পেরেছি, আমার বিশ্বাসের বিস্তার কতদূর পর্যন্ত নিজস্ব মেরুদণ্ডে বিশ্বাসী থেকেছে, এসবই কথাতে উঠে আসে, আমার সামনে সর্বদা আমি এসেই দাঁড়াই, তাই এসব প্রশ্নের জাল বিস্তার আমাকে ঘিরেই, প্রশ্নের হাত ধরেই পায়ের তলার মাটি আস্তে আস্তে শক্ত হয়, প্রশ্নই তো উত্তরের ছুঁচালো ঠাণ্ডা বাতাস, যেকোনো দিক থেকে আমাকে ফালাফালা করে চিরে দেয়
( দশ )
উঠোন পরিষ্কার না করে আমি এখন আকাশ পরিষ্কারের জন্যে ঝাঁটা ধরেছি, অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায় আমার উঠোন, কত কত মানুষের পায়ের ছাপ, মানুষ ছাড়া আরও কিছু কিছু অন্য পা-ও দেখা গিয়েছিল, উঠোন ঝাঁটা দেওয়ার অভিজ্ঞতা না থাকায় তাদের ঠিক চেনা যায় নি, হাত পায়ের ধুলোয় উঠোন এত মোটা হয়ে গিয়েছিল যে নড়বার শক্তিও ছিল না, অনেকদিন ধরে এক আবহাওয়া চলছিল, গাছের মুখভার আমার চোখে পড়ে নি, মনে হয়েছিল যুগ যুগ ধরে একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা যার রক্তে তার মুখে উঠোনের কথা পরচর্চা পরনিন্দা গোত্রভুক্ত, পাতার আয়না কালি হতে হতে যখন আলো নিভে আসছে তখনও আমি উঠোন পরিষ্কারে মত্ত
( এগারো )
দোকানের আলো জ্বলে উঠলে অনেকগুলো মুখ এগিয়ে আসে, ঠিক যেমন আলো দেখে পতঙ্গেরা, দোকানের দুঃখের সঙ্গে মুখের দুঃখ মিলে গেলে নীল রঙের এক অদ্ভুত আলো জ্বলে ওঠে, দুঃখ মুখগুলো তখন আলোর বৃত্তে জড়ো হয়, তাদের হাত পা-গুলো এমনভাবে নড়াচড়া করে দেখে মনে হয় তারা অনেকদিনের চেনা, বছরের পর বছর অদেখায় কথার পাহাড় জমে থাকে, কি দিয়ে তারা শুরু করবে খুঁজে পায় না, ঠিক এমন সময় বৃষ্টি শুরু হয়, কারও দুঃখ জলে মিশে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে, কারও দুঃখ ঘন হয়ে গিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত মাটিতে আটকে থাকে, তেতে যাওয়া মাটিতে বৃষ্টি পড়লে যেমন সোঁদা গন্ধ বের হয় তেমনি কিছু কিছু দুঃখকে সবাই গোল হয়ে ঘিরে ধরে, বৃষ্টি থেমে যায়, দুঃখ নিয়ে বেশিরভাগ মুখই নদী মাঠ পার হয়ে বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে, কয়েকটা মাত্র মুখ গভীর রাত পর্যন্ত দুঃখ নিয়ে পায়ে পায়ে জড়িয়ে পড়ে, পরের দিনের পঁচিশে বৈশাখের কাগজে দুঃখের ছবি বেরোয়, দোকানের নীল রঙ কাগজে ততক্ষণে গোলাপী হয়ে গেছে, তবে জন্মদিনের আগে খুশির বৃষ্টি সকালের " হে নূতন " জমিয়ে দিয়েছিল
( বারো )
চোখের দেখা জল হাওয়া মাটি থেকে অনেকখানি সরে গিয়ে তোমার ঘর, জন্মেই যে মাটি জলে চামড়া ধুয়েছি তা অনেকটাই একঘেয়ে এবং অনায়াস, তার জন্যে কোনো দৌড় শুরুর প্রস্তুতি নেই, ডাল ভাত খেয়ে ভোর থেকেই সবাই রেললাইন ধরে ছুটছে, এখানের ফলাফল আকাশ ছোঁয়ার অনুকূল নয়, সুবিধা মতো যে কেউ যখন তখন ইচ্ছে করে লম্বা হয়ে অনেক কিছু পেড়ে নিতে পারে, বেঁটেরাও তাদের উচ্চতায় পকেট পেয়ে যায়, এই খোঁজাখুঁজিতেই চৌকাঠ পেরিয়ে রাস্তায়, মনে পড়ে যৌবনে কে যেন গান শুনিয়েছিল, তার দু'হাতের মধ্যে ধরা ছিল গানের মাটি, আয়নার মতো সেই রঙে দেখেছিলাম তোমার মুখ, একবার মাত্র মুহূর্তের জন্যে, অনেকখানি ঘুরে গেছি, আরও ঘুরতে চাই, জল নেই তাই মাটি মাখতে পারি না
( তেরো )
তুমি থেকে তোমাতে পৌঁছাতে গিয়ে এক ছুটে যতখানি যাওয়া যায় তার সবটুকু গাঙ্গেয় সমভূমির মৌসুমী বায়ু অঞ্চল, সামান্য একটু নাড়া দিলেই ঝরে পড়ে বৃষ্টি, বোঝারই উপায় থাকে না মাটি কতটা কঠিন হতে পারে, ঘরের মেঝেতে বীজ ছড়িয়ে ফসল তোলা আমরা খোলা মাঠে পিঠে খাই নি রোদ, উৎসাহে ভাঁটা নেই, আবার এক ছুট, খাঁচায় ফাঁকফোকর থাকলেও শুরু হয়ে গেছে ক্রান্তীয় জলবায়ু, একটানা গরম, কখনও আবার ভেজা ভেজা, নাক নেই, চোখ নেই, কান নেই, পাখি কোথায়, কেউ বলে উড়ে চলে গেছে, বারান্দা, সদর দরজার পাল্লা বন্ধ, পায়ে খাল ধরে গেলেও প্রাণান্তকর চেষ্টায় ছোটার ইচ্ছে, ততক্ষণে ছাদে আগুন, খিড়কি দরজা দিয়ে ঢুকে পড়েছে নিরক্ষীয় জলবায়ু, রাস্তাতেই খবর আসে রাতারাতি বাড়ি উঠে গেছে শহরে
"উঠোন পরিষ্কার না করে আমি এখন আকাশ পরিষ্কারের জন্যে ঝাঁটা ধরেছি, অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায় আমার উঠোন, কত কত মানুষের পায়ের ছাপ, মানুষ ছাড়া আরও কিছু কিছু অন্য পা-ও দেখা গিয়েছিল, উঠোন ঝাঁটা দেওয়ার অভিজ্ঞতা না থাকায় তাদের ঠিক চেনা যায় নি"- অসম্ভব লাইন গুলো দাদা, মাথা নত হয়ে গেল। খুব ভালোবাসা।
ReplyDelete