কবিতা-গ্রন্থ আলোচনা , বিশ্বজিৎ দাস



বিশ্বজিৎ দাস এই সময়ের বাংলা কবিতার এক তরুণ কবি এবং একটি পরিচিত নাম।  ছায়ারোদ - নামে একটি ই-ম্যাগাজিন সম্পাদনা করছেন । 

আজ বিশ্বজিৎ দাসের কলমে উঠে আসা কবি আফজল আলির একটি কাব্যগ্রন্থ আলোচনা। 


ভালোবাসার দরবার থেকে কবিকে দেখি

_________________________________________


কবিতাগ্রন্থ : মোঘল দরবার থেকে

         কবি : আফজল আলি


"হরিপাল লোকাল থেকে ধনেখালি হল্ট" বাংলা কবিতার এক অন্য আঁতুড়ঘর। "ওই মনকেমনের গল্প শুনে" আমিও "ঘুমের মধ্যে নীলপরিদের আনাগোনা" দেখি। কবি আফজল আলি রূপকথাদের ভিড়ে দাঁড়িয়ে তাই বলেন,


"তারাদের দূরাভাষে সাজাবো

পৃথিবীর রূপ; তুমি থাকো ছাই না থাকো।"


স্বপ্নের ভিতরে দেখেন,


"সেই মুঘল দরবার থেকে তুমি যেভাবে

নেমে আসছো, আমার যান বলতে এই টু-হুইলার।"


এক দৃশ্যের থেকে অন্য দৃশ্যের মধ্যে অনায়াসে তাঁর যাতায়াত,


"আমার নিয়তির উঠোনে সামঞ্জস্যহীন হলুদচোয়ানো নাচ/ আমি বলছি না যে সাদা পাঁজরের উপর গোত্রহীন নামের/ রেখাপাতগুলো শুধু স্বপ্ন হয়ে উড়ে যেতে চায়।"


অস্তিত্বের খুব কাছে বসে তিনি বলেন,

"শ্বাসকষ্টে বুকের ভিতর বাতি নিভছে

এত তীব্র কষ্ট আমি তো নিরুপায়।"


বাংলা কবিতার এই ধ্রুবপুত্রের প্রতি সন্ধ্যায় নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার যে অস্থিরতা, যে কাতরতা, যে সিডেটিভ ক্যাপসুল, তা আসলে তাঁর কবিতার মধ্যেই ঈশ্বরচেতনার বহিঃপ্রকাশ। তাঁর কবিতা,


"আমার কবিতা আমার ঈশ্বর অনুভবের মাধ্যম।"


জীবনের জলাজমিতে তিনি হেঁটে বেড়িয়েছেন। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত কবি এক সময় তন্দ্রাচ্ছন্নে  ঘুম ও স্বপ্নের মধ্যবর্তী তীব্র ছায়াকে স্তব্ধতার বুকে রেখে বলেন,


"এইভাবে ভরসা রাখার মতো যে ফিঙেপাখিটা

উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে"


তবু কবিতাই যার জীবন; তিনি তো এই প্রকোষ্ঠ ছেড়ে বাস্তবতার দিকে চেয়ে থাকেন। এইরকম একটি বিশ্বাসের সুরে বোধের রঙ ছড়ান,


"আর আমি যেন সেই সূর্য থেকে ছিটকে আসা

সবুজ নীল দোয়েল।"


বিষয় ও শব্দ নির্বাচনেও স্বতন্ত্র তিনি। মোঘল দরবার, আবছা জন্মতারিখ, নিশ্চিন্ত কাচ, অবসরের শার্ট, প্রাইমারি স্কুলের চওড়া গেট, শ্রীরামের গন্ডি, রাস্তার শ্বাসফেলা ইত্যাদি আরও বহু শব্দের ডিসকোর্স ভেঙে নিজস্ব পরিমিতবোধ তৈরি করেছেন।


ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের নাম দিয়ে শুরু হলেও এ কবিতাগ্রন্থ আদতে সমকালীন জীবনের এক প্রকৃত দর্পণ। যেখানে ধর্মবিশ্বাস এসেছে। পোস্টমডার্ণ ভাবনা ও সংকট এসেছে; এসেছে বারবার প্রিয়জনকে হৃদয়ের সত্যিগুলি বলবার এক কাতর আবেদন। অভিমান আছে; অভিমুখও আছে। আছে নীরবতা। তাঁর শব্দবন্ধ প্রতিদিনকার জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা মায়াবীঘোর। সহজ সরল কথায় কবিতার ব্যাকরণ তিনি স্বচ্ছ পরিসরে বদলে দিয়েছেন। এই কবিতা, এই জন্ম, এই উপলব্ধি তাঁর, 


"একবার বুঝিয়ে বলো

আমি ধৃতরাষ্ট্র হয়ে উঠছি কেন?"


তবুও এই পৃথিবীর অঙ্গীকারনামায় যে দুধসাদা আকাশের কথা আছে, তাও তো তাঁর মধ্যবিত্ত জীবনের অপকট উচ্চারণ, --


"কেন হাজারের মধ্যে/ মিশে যাওয়ার প্রবণতা, দিন দিন গাধার খাটুনি,/ অফিসের সংকট আর একটি তীব্র ছায়াকে জড়িয়ে বেঁচে/ থাকার প্রয়াস।"


বাংলা কবিতায় আফজল আলি না বলে তিনি কে এবং কেন এই প্রশ্ন করলেই আমরা চিনব তাঁকে। বহু পত্রপত্রিকায় লিখে চলা মানুষটি এখনো জিরো বাউন্ডারি গ্রুপের মাধ্যমে মোঘল দরবার খুলে বসেছেন। তবে শাসন নয় ভালোবাসা এ দরবারের মূল অ্যাসেট। কবিতার নিজস্ব জগতের পাশাপাশি তিনি কবিতার স্কুলিং নিয়ে যথেষ্ট প্রয়াস তুলে ধরছেন। তাঁরই হাত ধরে বাংলা কবিতায় অনেক তরুণ কবির আবির্ভাব এখন সম্ভবনাময় দিকে এগিয়ে চলেছে। আমার এই প্রিয় মানুষটির জন্য তাঁর ভালোবাসার দরবারে এই শুভেচ্ছা আমি রাখলাম।


কবিতাগ্রন্থ : মোঘল দরবার থেকে

কবি : আফজল আলি

উৎসর্গ : সোনালি ও আমার স্বপ্নদের

প্রকাশক : কবিতা পাক্ষিক

প্রথম প্রকাশ : ২০০৯, কলকাতা বইমেলা

মূল্য : ৫০ টাকা

Comments

Popular posts from this blog

শম্পা সামন্তর কবিতা

মোনালিসা রেহমানের কবিতা

বিবেকানন্দ দাসের কবিতা