আমিনা তাবাসসুমের কবিতা
আমিনা তাবাসসুম, এই সময়ের অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এক নাম । মুর্শিদাবাদ জেলায় বাড়ি । বাংলা অনার্স নিয়ে পড়াশোনা। । তার কবিতায় থাকে আবেগ ও মর্মবোধের দ্যুতি যা পাঠকের গভীরে প্রবেশ করতে পারে । সনেট পাবলিকেশন থেকে "আবেগের ঠোঁট" সংকলন এর সম্পাদিকার কাজ করেছে। এছাড়াও কাচের জানালা সংকলন,ডহর পত্রিকা, চাতক পত্রিকা, আয়না কবি, কচি পাতা, আগডুম বাগডুম, কিশলয় পত্রিকা থেকেও তার কবিতা প্রকাশ পেয়েছে। যুক্ত আছে জিরো বাউন্ডারি গ্রুপের সাথে ও ।
আজ জিরো বাউন্ডারির একক উদযাপন বিভাগে থাকছে আমিনা তাবাসসুমের নয়টি কবিতা।
১ : পৃথিবীটা বড্ড মিথ্যে
শূন্যতার আর এক ধাপ ওপরে
আমি,
প্রক্ষোভ টুটে গেছে সব,
লঙ্কার অনুভূতি বুঝি না আর
কিংবা ভালো থাকা কাকে বলে যেন!
শহরের হলুদ কুটিরের এক প্রান্তে
মোমবাতির শেষ সলতে বাকি শুধু
এক আকাশ মরুভূমি বুকের বাম পাশে,
জীবনটা বাঁশ পাতা হয়ে গেছে...
কালো কালো রক্তের কথকতা
আর চাপা উৎকন্ঠা--
ধূসর পৃথিবীটা বড্ড মিথ্যে
ক্লান্তিতে ঘুম নেমে আসে চোখে
যখন শিলালিপি প্রতারক হয়
একাকিত্বকে তখন কে আটকায়...!
২ : আধখানা চাঁদের ডিমের ভিতর
আধখানা ডিমের ভিতর চাঁদ ডুবছে ক্রমশ...
শালিকের লড়াইয়ে ক্লান্ত হয়ে জোৎস্না ঘুমিয়ে পড়েছে,
আর,
প্লাজমাতে সাইটোকাইনিনের অবিচ্ছেদ্য কিছু খসড়া
ভ্রমিত করে চেনা রাস্তা,
ভিখিরির থালা চোখের জ্যোতিতে বড্ড জ্বালা ধরায় আজকাল,
নিজেতে বিমুখ হয়ে আর কত শব্দের কাটাকুটি হবে?
চিনতে চাওয়ার অজুহাতে নষ্ট করেছ পরাগ
বুঝতে দাওনি সীমা লঙ্ঘনের একরাশ অভিসন্ধি,
দেখতে দেখতে বসন্ত কাটলো বাইশ টা
আর স্বপ্নের মৃত্যুগুলো ডুব দিল সাগরের নীলে.....
৩ : একদিন এমন আসবে
সব যন্ত্রণার অবসান হবে
হুগলি থেকে বর্ধমান
কিংবা কলকাতা থেকে কোচবিহার
সব বিচ্ছেদের অবসান হবে
সব...
কপালের ওই বিশেষ চিন্তার ভাঁজ
আর দায়িত্বের এক ঘেয়ে বন্দি জীবন
এক একটা কষ্টে ঢাকা নীরব চিৎকার
সব কিছুর অবসান হবে
সব.....
সুদূর আকাশের নীলবর্ণ চোখ
আর সময়ের দড়িতে মাপতে থাকা
এক একটা নিঃশব্দ কাঁটার খোঁচা,
দিগন্তে পেঁচিয়ে আসা অবসাদ
সব কিছুর পূর্ণতা পেরিয়ে
আসবে মুখরিত নতুন সকাল।
৪ : আকাশ এবার আমার হোক
চোখের জলের পর্দা অনেক কাটা তারের মায়াজাল
বালিশ ভেজে লোনা জলে আগলে রাখি চিরকাল
বৃষ্টি ছোঁয়ার ভীষণ লোভে আকাশ খুঁজি মৃত্তিকায়
বুকের ভেতর জ্বললে আগুন তখন বলো কে নেভায়?
ছন্দ সুখে কাব্য লিখি, একুশ আমার অহংকার
বাতাস থেকে মুক্তি আনি খুবলে নিয়ে অলংকার
চোখের তারায় আগুন রাঙ্গা, বুকের মাঝে সুনামী
এক'শ মরা জিন্দা করি, লাশের কবচ বেনামী..।
মরুভূমির বালুচরে তৃষ্ণা চাতক বেওয়ারিশ
মরীচিকার আত্মভরে তখন কেবল জেলিফিশ
কান্নাগুলো বিবাদ করে, জ্বালিয়ে দি' দুঃখ-শোক
আনবো ডেকে বৃষ্টি আমি আকাশ এবার আমার হোক।
৫ : সাইটোপ্লাজমের গভীরে
কতদিন হাওয়া খাইনা প্রাণ ভরে
কোকিলের কণ্ঠে বিষাদ আসে না কখনো
সুরে কেবল আবেগী অহংকার।
চোখের লজ্জাদের নিলাম করেছি সমুদ্রে
টিকটিকির লালারস থেকে তৈরি হওয়া মানচিত্রে
গল্প লিখেছি নিত্যদিন..।
সাইটোপ্লাজমের কোষের গভীর উপত্যকায়
চোখ বেঁধে লুকোচুরি খেলছিলাম
আমি।
পিসিমা ডেকে বললো বয়সের নিচে দাগ পড়েছে।
সময়ের বিচ্ছেদ অনুষ্ঠানে ডাক দিলাম প্রেমিকের।
তারপর নুড়ি পাথর বালির চিৎকার...
এখন আমি দীর্ঘশ্বাস গুনি থলির ভেতর।
৬ : বিচ্ছেদের উল্লাস
চাবুকের মতো কিছু এলোমেলো শুকনো পাতার আস্তানা
গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর যোনিতে আটকে
ক্ষয়ে যাওয়া পথিকের চোখ।।
শূন্যতার অন্যমনস্কতায় তখন ঠিকরে পড়ছে বারুদ
ভৈরব নদীর দু'কুল বেয়ে
এঁকেবেঁকে আসে পাহাড়ী বাতাসের চিৎকার।
কফিনে সাদা মেঘের ক্লোরোফিল
শান্তির চকমকি ঝিলিক দিচ্ছে মেঘে।
আলোতে তখন বিচ্ছেদের উল্লাস!
৭ : বাক্যালাপের অমৃত
সারা রাত্রি বিছানা জুড়ে উপচে পড়ে স্বপ্নের বন্যা
কন্যাকুমারীকা থেকে হিমালয়
কিংবা গুজরাট থেকে মেঘালয়
সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
সূর্যের সঙ্গে প্রদীপের সহবাস
আর উষ্ণতা জুড়ে তোলপাড়।
ঘটনার ক্রম বড়ো এক পেশে
সারাক্ষণ কেমন বুকের ভেতর মহাসাগরীয় ঢেউ।
ভঙ্গিল পর্বতের চাপ এখন ঠিক হচ্ছে না
তবু মশলা মুড়িতে ভুল করে মেশাচ্ছি বাক্যালাপের অমৃত।
৮ : সঙ্গিনীর ঠোঁটে অদ্ভুত মাদকতা
দেখতে দেখতে সকাল ঘনিয়ে রাত হলো,
পাতায় পাতায় নেমে এলো অন্ধকার
চৌম্বকীয় তরঙ্গ গেঁথে গেল দেরাজের সুখের সাথে এক পশলা বৃষ্টির।
আকাশ থেকে নেমে আসলো শান্তি।
ভোরের পাখিরা নীল আলোয় খুঁটে খেলো প্রেম,
সঙ্গিনীর ওষ্ঠে অদ্ভুত মাদকতা তখন।
আমি জানলা দিয়ে দেখছি,
কীভাবে ঝুপ করে পৃথিবী পরিবর্তন হচ্ছে।
নিমেষের গরলে অমৃতের স্বাদ নিতে নিতে
আমার চোখে অন্ধকার নামলো।
৯ : অতীত বিক্রির মরশুম
চব্বিশ বছরের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে
বারবার ভুল হয় হিসাবে।
লবণে দীর্ঘ রাত্রির বিষাদ জড়িয়ে
ভোরবেলা জল আনতে যায় পাড়ার তৃষ্ণা।
বায়োলজির মাস্টার বললেন সালোকসংশ্লেষ আর পাতার সম্পর্ক
সবসময় ঘোড়ার দৌড়ের উপরে থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম এখন গৃহবন্দি,
সুপ্রিমকোর্টের আদেশ, ধূলি আর জলে যেন সংমিশ্রণ না হয়।
ঘড়ির কাঁটায় যখন দুপুর দুটো,
বুকের ভেতর ধক করে উঠলো
সমানুপাতিক চৌরাস্তার মোড়ে অতীত বিক্রির মরশুম চলছে,
চোখ প্রসারিত করতেই দেখি
ভবিষ্যত এখন বাক্সবন্দী....!!
"এক আকাশ মরুভূমি বুকের বাম পাশে," "যখন শিলালিপি প্রতারক হয়," "শালিকের লড়াইয়ে ক্লান্ত হয়ে জোৎস্না ঘুমিয়ে পড়েছে," "আর স্বপ্নের মৃত্যুগুলো ডুব দিল সাগরের নীলে," "দিগন্তে পেঁচিয়ে আসা অবসাদ", "চোখের জলের পর্দা অনেক কাটা তারের মায়াজাল," "চোখের লজ্জাদের নিলাম করেছি সমুদ্রে," "শূন্যতার অন্যমনস্কতায় তখন ঠিকরে পড়ছে বারুদ," "তবু মশলা মুড়িতে ভুল করে মেশাচ্ছি বাক্যালাপের অমৃত," "ভোরের পাখিরা নীল আলোয় খুঁটে খেলো প্রেম," "সমানুপাতিক চৌরাস্তার মোড়ে অতীত বিক্রির মরশুম চলছে," - অসাধারণ সব চিত্রকল্পসমৃদ্ধ এই বর্ণিল শব্দগুচ্ছগুলো আমাকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করল। ভিন্ন আঙ্গিকে আবেগের পরিভাষা নির্মাণে কবির বিশেষ দক্ষতা লক্ষ্যণীয়। সহজসরল উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে কবি যে-জীবনবোধের দ্যোতনাকে ধারণ করেছেন তার কাব্যিক কথকতার মধ্য দিয়ে তা সত্যি অভূতপূর্ব। শব্দ ও রূপকল্প ব্যবহারে কবির পরিমিতিবোধ প্রশংসা করার মতো।
ReplyDelete