অনিরুদ্ধ আলমের কবিতা
সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত
অনিরুদ্ধ আলম (Anirudha Alam) পেশাগত জীবনে একজন ফ্রিল্যান্স উন্নয়নকর্মসূচি কন্সালটেন্ট এবং উন্নয়ন-যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি এ পর্যন্ত চল্লিশটিরও অধিক বই লিখেছেন এবং সম্পাদনা করেছেন। তাঁর প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: সোনালি নৈঃশব্দ্যের হরিণাবলি (কবিতা), প্রেম কি কেবলি পাখিপ্রবণ (কবিতা), ভালবাসা প্রিয়তমাসু (কবিতা), অনেকটা পথ হাঁটতে হবে ঘুমিয়ে পড়ার আগে (কিশোর কবিত), ২৪ অক্টোবর ১৯৭১ (উপন্যাসিকা), এইসব রাতদিন (কিশোর কবিতা), দূরের ডাক (ছড়াকবিতা), তারপর তারপর (ছড়া), সকলের জন্যে পরিবেশ পরিবেশের জন্যে সকলে (ছড়ানাটিকা), পিঁপড়ে (সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস), অপারেশন ক্যালপি বত্রিশ (সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস), এবং ক্রিনোর অপেক্ষায় (সায়েন্স ফিকশন), তেইশ শত দুই সালের এক জানুয়ারি (ছোটো গল্প), দু’ শ’ বছরের সেরা বাংলা কিশোর গল্প (সম্পাদিত গল্পের সংকলন), তোমাদের জন্যে বাংলা বানান (বাংলা বানান বিষযক প্রবন্ধ), আমাদের কালো মানিক: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (জীবনী)।
শিক্ষাগত জীবনে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, ইংরেজি সাহিত্য এবং কমপিউটার-প্রযুক্তি বিষয়ে
দেশেবিদেশে পড়াশুনা করেছেন। বর্তমানে সপরিবারে টরোন্টো, কানাডায় বসবাসরত।
আজ জিরো বাউন্ডারির একক উদযাপন বিভাগে থাকছে প্রবাসী এই কবির একগুচ্ছ কবিতা
পাঞ্চবি দ্বীপে নৌকাটে চতুর্দশীগুলো
১: আঁচড়
চিলেকোঠাতে সূর্যোদয়ে আঁচড় কাটে বেলা
কাঁকড়ামতো টুকরো ছায়া সিঁড়িতে হাঁটছিল!
দেয়ালঘড়ি কি তড়িঘড়ি ক্ষণের ছেলেখেলা?
টেবিলজুড়ে হাওয়াতে বই শরীর মেলে দিল।
গলির মোড়ে বাড়ছে ভিড় একটু করে ক্রমে
ব্যস্ততাতে বোঝাই সব রিকশা ছোটে ধীরে
শরৎ নিয়ে কিছু তো প্রেম ধুলোর বুকে জমে
পাঁচিলে-খসা পলেসতরা আলোতে এল ফিরে।
পাঞ্জাবিটা চাপিয়ে গায়ে বাইরে চলে আসি
আজ কি কোনো শুক্রবার? অন্য কোনো দিন?
কোথায় যাব?– ভাবছি খুব। হাঁটতে ভালবাসি
নিরালা, তুমি তখনো এই হৃদয়ে ধূ ধূ লীন।
দেখেছি– পথে বিয়ের শোভাযাত্রা দিল উঁকি
তুমি কি শুধু শিল্পী? মনে কাটো যে আঁকিবুঁকি!
২: গ্রহান্তরে
কোনো কি ঘোড়া উড়তে পারে? তোমার জানা আছে?
গ্রহান্তরে উড়িয়ে দিই আড়ষ্টতা কিছু
ধূমকেতুর অতীব গতি আকাঙ্ক্ষাতে বাঁচে
কোন সে-নীহারিকাতে তুমি? তোমার নেব পিছু।
আঁধার মৃত রাতের ভারে ক্লান্ত সঙ্গিন
তবুও নানা নক্ষত্র দিয়েছি আমি পাড়ি
প্রতীক্ষার সীমানা থেকে পাখিরা খোঁজে দিন!
ছায়াপথের অলিগলি কি মায়াতে সঞ্চারী?
উপেক্ষিত স্বপ্নগুলো করুণা করে যায়
তাতে কী? আশা আবর্তিত বোধনে করে ভিড়
কোথাও আমি থেকে তো যাই সীমান্তের গাঁয়
উল্কাপাতে সংশয়রা হোক-না চৌচির।
ঘোড়ার খরদ্রুতি এ মনে কালের স্রোতে নাচে
ঠিকানা দাও। পলকে ছুটে যাব তোমার কাছে!
৩: অস্থিরতা
দেয়ালে-ঝোলা ছবির সাথে হয় নি আলোচনা
শিশুপার্কে তবুও গিয়ে থাকতে হবে ব’সে
সবুজ ঘাস চিরন্তন মোহের কোনো ফণা!
অস্থিরতা লেহন করে আমাকে কোন দোষে?
ও-সূর্য কি নীলাকাশের নিরন্তর ক্ষত?
হৃদয়ে রূঢ় বেদনা জ্বলে চকিত উদ্গমে
আমি কি কারো কৃপাপ্রার্থী? জানি না অন্তত –
ছায়ারা বুঝি সর্পাহত! ভীষণ থমথমে।
ব্যথার ঘোর মিছিল হয়ে বাদামখোসাগুলো
চমকে ওঠে হাওয়ার তোড়ে। ডেকেছ যদি, তবে
এলে না কেন? বিচ্ছিন্ন উড়ছে কিছু ধুলো!
মেঘের স্নেহে আঁধার নামে। বৃষ্টি হবে-হবে।
শূন্যতার ঊর্ধ্বমুখী দেয়াল ঘিরে ধরে
ওখানে আমি আছি তো বেশ আপন কোনো ঘরে!
৪: সম্বল
ডাহুকী নদী, শঙ্খমালা, স্বপ্নে-দেখা ঘুড়ি–
এসব ছিল আমার সে কী সুপ্রিয় সম্বল
এখন নেই; কেবলি খেলে এ মনে লুকোচুরি!
অনিশ্চিত বদ্বীপ ছেয়ে সাগর আঁকে ঢল।
অনিবার্য একাকীত্বে কুয়াশাহত থাকি
হরিণাবলি কোথাও হল শস্য-সঙ্কেত
করুণ কাক উড়াল মেলে। দৃষ্টিজুড়ে রাখি
শশার কাচা সুবাসে জাগে পোড়োমাঠের ক্ষেত।
নুনের মতো তীক্ষ্ণ ক্ষয় বাতাসে জেগে আছে
যুবক, তুমি বৃষ্টিহীন বিস্ফোরণে ধৃত!
হও নি ক্ষোভে সংক্রামিত চোরাটানের কাছে?
মনন বেয়ে সুখজ ব্যথা নিয়ত কেলাসিত।
কচ্ছপের মগ্নতাতে অতৃপ্তির কায়া
পোশাক হয়ে আমাকে দেয় রঙিন প্রচ্ছায়া!
৫: ঘূর্ণন
পাহাড়ি স্নেহে উঠেছে মেতে আলোর ঘূর্ণন
বাহারি কোনো লাটিম বুকপকেটে নিয়ে আমি
সারাটা বেলা ঘুরেছি সে কী! ছেলেবেলার ক্ষণ
নদীর মতো এখনো মনে ছড়ায় পাগলামি।
মনটা জুড়ে উপত্যকা? মায়াবতীর মায়া
এখানে ধূ ধূ পায়রা হয়ে বেড়ায় শুধু উড়ে
গিয়েছে ফেলে আন্দোলিত তীব্র প্রচ্ছায়া।
থাক-না ক্লেশ ছন্নছাড়া অচেনা বহুদূরে!
দূরের ঘেসো মালভূমিকে কতটুকু-বা জানি
উপায়হীন অভিব্যক্তি হয়-না বর্ণিল
ছোঁ মেরে আজো খামচে ধরে মূর্তিমান গ্লানি
আমাকে বুঝি ছিনিয়ে নেবে– যেন তা রূঢ় চিল!
পাহাড় ক্ষ’য়ে ক্লান্তি জমে ঝোরার আয়নাতে
আমার দ্রুতি পেয়েছে দ্যুতি এমনও গিরিখাতে!
৬: চক্রব্যূহ
প্রশান্তির মতন কোনো চক্রব্যূহ ছেয়ে
গাছেরা যূথবদ্ধ হয়ে গাছের কাছে থাকে
নিগূঢ় ক’টি দুঃখবোধ শিকড়গুলো বেয়ে
ছড়িয়ে পড়ে মস্তিষ্কে ডালপালার বাঁকে–
‘মানুষ কেন ব্যস্ত খুব হনন পরিসরে?
প্রকৃতি হয়ে করুক নানা মোহের সাশ্রয়!’
এসব কিছু ভাবতে গিয়ে গাছেরা অন্তরে
নিজেকে কত গুটিয়ে রাখে উজিয়ে সংশয়।
ঘাড়ের কাছে ঝাঁকড়া চুল সবুজ হল আরো
পাখিরা যত সুদূরে যায়, ততই কাছে আসে!
বৃক্ষগুলো দেবতা হোক। দেবতাগুলো গাঢ়
লতানো জীব হয়েছে বুঝি দেবালয়ের পাশে?
চক্রব্যূহ, নিয়ত তুমি প্রাকৃত সাত্ত্বিক
নিমগ্নের কাব্য হয়ে থেকো তো লৌকিক!
৭: ফেনা
নীলিমা-স্নাত আলোর ফেনা দোর্দণ্ড দিনে
বিচ্ছুরিত। ডানার মতো সহজ সাবলীল
মেঘেরা ধৃত কী অভিলাষী পাখালিদের ঋণে!
তুমি তো আছ। সার্থকতা হয়েছে বর্ণিল।
মৃত্তিকার মতন দৃঢ় মুগ্ধতার স্বর
সদ্যোজাত প্রচ্ছন্নে আমাকে পিছু ডাকে
সমার্থক না-হোক নীড়। না-হোক কোনো ঘর -
তবুও পড়ে থেকেছি আমি প্রতীক্ষার বাঁকে।
নষ্ট ফলে তুলেছে ফণা ঝাঁঝাল মৃত স্বাদ
অমন নানা হতাশাবোধ না-থাক আয়োজিত
স্মৃতি ও প্রীতি উচ্চকিত মিলিয়ে কাঁধে কাঁধ
ঘৃণাতে প্রেম প্রেরণা হয়ে হবে যে উপনীত।
আলোরা আরো সারস হয়ে বাতাসে ধ্যানী হয়
তেমন করে মননে করি তোমাকে সঞ্চয়!
৮: লীন
নীলাকাশের পাশেই লীন এখানে নদীঘাটে
কচ্ছপের মতন নেমে এসেছে উদ্যান
কামার হয়ে তামার রঙ আলোর পাটেপাটে
পুষ্পমতি ফুলকি আঁকে। হৃদয় আনচান -
কোথাও আজ যেতে কি হবে? আলিঙ্গনে কেউ
ডেকেছে কবে? কত-না পথ রয়েছে পড়ে একা
পাঁচটি টিয়ে মাড়িয়ে গেল বাতাসে-ভেজা ঢেউ
কিছু তো হাসি গুছিয়ে রাখে লাবণ্যের রেখা।
শিল্প হবে? জেগেছে মনে তৃষ্ণার্ত বোধ!
কবিতা কোনো স্পর্ধা, হাঁসের ঢঙে ওড়ে?
ব্যক্তিগত বেলাতে কত সাজাই নানা রোদ
পক্ষপাত-দুষ্ট ক্লেশ আমাকে রাখে ক্রোড়ে।
আমাকে রাখে আকাঙ্ক্ষাতে দাবালনের ঘ্রাণ
তোমার দিকে মনকে করে নিয়ত টানটান!
৯: সূচিশিল্প
উজানো এক-বেদনা আছে মননে পরবাসী–
সারাটা বেলা সূচিশিল্পে নিয়ত নিয়োজিত
করুণ বাঁশি কোথায় বাজে? কোথাও খুঁজে আসি!
আমাকে কেউ শর্তহীন ভেবেছে বাঞ্ছিত?
ভাবুক আরো? ভূপৃষ্ঠের মায়াতে ছায়ালতা
সর্বাংশে মেলুক ছোঁয়া। চিন্তাক্ষম রোদে
ফুটেছে ক্ষণ দুপুর হয়ে। সমধর্মী কথা
নূপুর হল। তুলেছে সুর। গুছিয়ে রাখি বোধে।
গুছিয়ে রাখি চিন্তনীয় নানান বিন্দুতে
শূন্যতার সমীকরণ। অনুরোধের প্রকৃত অধ্যায়
সমূহ কোনো বিতর্কের নবীন সিন্ধুতে
কী ঊর্মিল! সে ছিল তো গতির নীলিমায়।
গতিতে লীন বস্তুরূপ বিশেষত্বে ঝরে!
আমাকে তুমি রেখেছ বুঝি দশমিকের পরে?
১০: প্রবোধ
যাপিত পাখি খুঁজেছ শুধু দিকচক্রবালে
প্রলয় ধূ ধূ প্রলেপ হয়ে সাজাল সংশয়!
প্রবোধ কোনো পুরুষোচিত রোদের করতালে
স্নিগ্ধ এক-সন্ন্যাসিনী করে নি সঞ্চয়?
তীব্র ঘাস বাতাসে গোঁজে কাঁপন উত্তাল
ভেবেছে লতা, ‘ব্যাকুলাঙ্কে লুটিয়ে-পড়া নীড়
প্রতীক্ষার বিজ্ঞাপন থাকবে কতকাল?’
দূরদর্শী লাটাই-টানে ঘুড়ি যে অস্থির!
কিশোর, নীলে অন্তরিন দৃষ্টি এঁকে যাও–
দিনপঞ্জি হারিয়ে গেছে! স্মৃতি কি পিছু ছাড়ে?
অস্তগামী হয়েছে কত সুরেলা কোশা নাও
মধ্যরাতে বন্ধ দোরে জোছনা কড়া নাড়ে।
মাটির প্রতি গাম্ভীর্য গাছকে রাখে মেলে
নিরালা, তুমি হলে তো পাখি। এ আমি এলেবেলে!
১১: ছায়াভ
ছায়াভ নানা উল্কপাতে চকিত পাড়াগাঁয়ে
বালিকাবেশী স্নিগ্ধ ঘ্রাণ কাউকে খুঁজে ফেরে?
কত যে দিন ঢালি নি জল লেবুগাছের পায়ে
এভাবে তিন-তিনটে শীত আমাকে গেল ছেড়ে।
নীলের গাঢ় মস্তিষ্ক-প্রসূত নীলাকাশ
পেরিয়ে গেছে হাওয়ার দূর শীর্ষদেশ। আলো
ওখানে ওড়ে। দানব হয়ে ছড়ায় উচ্ছ্বাস!
স্পষ্ট হৃদয়ে কেউ হঠাৎ চমকাল।
কুশলী কোনো চড়ুই পাখি সারাটা বেলা ধরে
মননে ঘুরে করছে তাড়া আমাকে থেকেথেকে!
এমন করে হৃদয় বেয়ে পাথরগুলো ঝরে?
শুধু কী তা-ই! গোলাপি ফুলে মেঘেরা যাবে ঢেকে।
কোথাও এই শুদ্ধ ক্ষণে যুদ্ধ লেগে আছে?
একটা মৃদু মায়াবী ছায়া ক্ষরণে জেগে আছে!
১২: বাজিমাত
(পেরিয়ে গেছে কত যুগান্তর
ভালবাসারা দীপ্তি হয়ে উজায় বাতিঘর…)
মানবতা কি– বনানীজুড়ে পাতারা নির্ভয়?
কিংবা ধরো এসেই তুমি রাখলে হাতে হাত
সাগরপাড়ে যাব না আজ। শঙ্খ-পরিণয়
তীরের বুকে উঠুক মেতে ছাপিয়ে বাজিমাত।
খাঁচার পাখি উড়িয়ে দিই। সকল উচ্ছ্বাস
দখলে রেখে সুখের খোঁজে হয়েছি কাপালিক
বোতাম পোকা জানুক তবে আমার বিশ্বাস–
ফাগুনগুলো ওদেরই হবে। ওরা যে রাজসিক!
যুদ্ধ কিছু থাকুক বেঁচে জনপদের প্রাণে –
পাহাড় কেটে হবে না কোনো রুদ্ধশ্বাস-গাঁও!
হরিণগুলো বেড়াক ঘুরে ঘাসের ঘন ঘ্রাণে
তোমার মনে উড়বে কত প্রজাপতির নাও।
রাত্রি এলে জোছনা শুধু মেলুক গাঢ় ফণা
মানবতা তো মননে বোনা আলোর উপাসনা।
১৩: সরলতা
একক পাখি কখনো যেন একেক সরলতা
তাম্রযুগ পেরিয়ে কবে এসেছি গিরিখাতে
অচেনা দূর দৃশ্যে ভেসে উঠেছে সভ্যতা
কোথাও বাজে ঘণ্টা জলহাওয়ার সংঘাতে।
ধ্বনির শুধু থাকতে আছে ধাতব অবয়ব?
ভেসে তো যাবে। যাক-না ভেসে কোঁকড়া মহাকালে
কাঠঠোকরা পাশেই ছিল। এও কি সম্ভব–
কেবলই হ্রেষা রয়েছে জমা রাজার ঘোড়াশালে?
যদিও জানি– বাতাবি লেবু ঊর্ধ্বমুখী নয়
সংবিধানে উল্লিখিত ‘কেমন আছ মন?’
যোগসূত্র খুঁজতে গিয়ে আমিও নয়ছয়
জানি না আজো– বুঝব কবে কাকলী-বণ্টন!
কার্পাসের মতন কিছু বিস্ফোরণে বোধ
চেঁচিয়ে বলে, ‘একলা পাখি নিও-না প্রতিশোধ!’
১৪: অভিভাবক
প্রতিটি রাতে শেকড়গুলো গজিয়ে ওঠে পায়ে
সকাল হলে ওসব ছেটে বেরিয়ে যাই কাজে
আলোরা হল অভিভাবক। বিকেলে চেপে নায়ে
নদীর তীরে বনানী খুঁজি রঙের নানা ভাঁজে।
তাতে কি কোনো যায় আসে না নকল ছায়াদের?
দুপুরবেলা সকল ঘোরে সাজিয়ে যাই কাকে?
ডহর কিছু পহর আছে নিরঙ্কুশ ঢের
মননে ছেয়ে তুলেছে ঝড় অকাল বৈশাখে।
তবুও বলি– মধ্যাহ্ন আমার বড়ো প্রিয়
আসুক যত সূর্যাস্ত, সুশীল হয় আশা
ফাগুন এলে আমার হয়ে হাওয়াকে শিস দিও
পশমি কোনো সুবাস শীতে বাঁধুক নীড়ে বাসা।
কালাকালের পরিক্রমায় বিশেষ কিছু রাত
বৃক্ষ হতে শিখিয়েছিল আমাকে দৈবাৎ!
১৫: দখল
চেয়েছি কত– আকাশ হোক আমারো অধীনত
সাঁতার শিখে দখলে নিই এ পৃথিবীর জল
বর্ধিষ্ণু অবিবেচনা হয় নি সংযত
দাঁতাল হল রাজসাক্ষী হাওয়ার বুনো ঢল।
কেমন করে শেকড়গুলো মেলবে ডালপালা–
কেউ কি নেই– গ্রামকে নেবে নগর-প্রাঙ্গণে?
দু’ বাহু দিয়ে আগলে-রাখা গৌরবের মালা
যুদ্ধপ্রেমী পরিয়ে দিল অশুভ পরিজনে।
শিশুর খেলাঘর তো রূঢ় বোমাতে ছারখার
কোমল তার কণ্ঠস্বর ধ্বনিত চারদিকে–
‘ঈশ্বরকে বলেই দেব সকল অনাচার!’
প্রকৃতির কি অস্তিত্ব আসছে হয়ে ফিকে?
জিঘাংসার জরায়ুজুড়ে জীবাণুগুলো নাচে
এ আমাদেরও মারণাস্ত্র ললিত বোধ আছে!
১৬: মানচিত্র
মগজে-আঁকা মানচিত্র ধূসর হয়ে আসে
হৃদয়জুড়ে তবুও পুষি মায়াবী হাকালুকি
নিরুদ্দেশ রেলগাড়ির চকিত ইতিহাসে
মরচে ধরে। এখুনি বুঝি বৃষ্টি দেবে উঁকি?
রুপোলি ক্ষতে বড়শি-গাঁথা জলের আলোড়ন
জলের দেশ। যেখানে জল হয় না নদীহারা
নদীর দেশ। যেখানে নদী বাড়ির পরিজন
বাড়ির দেশ। যেখানে বাড়ি সঘন কোনো পাড়া–
অনমনীয় ওসব আজো ছলকে পড়ে মনে
রঙের নানা বর্ণ থেকে স্নিগ্ধ অনুস্বর
মুদ্রাদোষে ডেকেছে শুধু কোথাও ক্ষণেক্ষণে
হৃদপিণ্ডে চমকে ওঠে স্মৃতির জাদুঘর।
দরজা খুলে দেখেছি– পথ হারিয়ে গেছে দূরে
আমার গ্রীবা দীঘল হল ও দিগন্ত ফুঁড়ে!
১৭: নদীকাতুরে
নদীকাতুরে বৃষ্টি এল। কাদাতে মাখামাখি!
মৃত্যুহীন আকাঙ্ক্ষারা কাকতাড়ুয়া হয়
কত যে দিন আঁকি নি কোনো মেধাবী উটপাখি
মুকুরে তুমি কারো কি মুখ করেছ সঞ্চয়?
কিছু তো ঢেউ সপ্তডিঙা! রুপোলি পদধ্বনি
ছড়াতে থাকে। দুমড়ে-যাওয়া বিষুবরেখা থেকে
দেখি নি চোরা মৃত্যুকূপ। বেজেছে খঞ্জনি!
হরিণান্ধ মূর্ছনাতে চেতনা গেছে ঢেকে?
কষ্টখ্যাত নষ্ট বেলা এসেছে নাইওর
নাবিক হতে চেয়েছিলাম আমিও একদিন
মহাদেশের মতন কোনো প্রলম্বিত ঘোর
পোশাক হয়ে শরীরজুড়ে হয়েই আছে লীন।
সুযোগ পেলে ঘুমকাতুরে সাগরপাড়ে গিয়ে
অবশিষ্ট আমাকে খুঁজি খসড়া নাও নিয়ে।
১৮: ঈর্ষণীয়
মোরগ ফুল বলতে আমি বুঝেছি যতটুকু–
বর্শামতো লালের আভা হয়েছে লেলিহান
দুলছে মাঠে ঈর্ষণীয় কাশের খোকাখুকু
বাতাসে কাঁপে ঝরাপাতার নিদাঘ প্রস্থান।
ওসব থেকে একটু দূরে নিরালা কুঁড়েঘরে
আলোরা ছায়া হয়েই পাতে কোমল গান্ধার!
জীবন বুঝি বর্ধিষ্ণু জিজ্ঞাসার ঝড়ে?
কে দিল মনে ব্যথাপ্রতিম চাষাবাদের ভার?
পরির মতো প্রতিভা নিয়ে জোছনা মাঝরাতে
জানালা ছেয়ে তৃষ্ণার্ত উপস্থিতি মেলে
মুঠোতে-ভরা চারণ-ছাই হাওয়ার সংঘাতে
হারিয়ে গেছে। স্মরণ, তুমি কিছু কি তবে পেলে?
চেয়েছি তবু বৃক্ষ হতে। আর যে কিছু নয়!
মৃত্তিকা তো চিরায়ু কোনো আত্মপরিচয়।
১৯: দোর্দণ্ড
দোর্দণ্ড দিনের রঙ লেগেছে দশমিকে
ইটের মতো নির্লিপ্ত মেঘের পাগলামি
দিকবিদিকে ডুমুরঘ্রাণ রেখেছে কেউ লিখে
শোভাযাত্রা বেরুবে নাকি? ঈশানে গিয়ে থামি।
দারুচিনির মতন খেরো কোন-বা দেশে থাকো
পাহাড় জানে স্বরাজ মানে ঝোরার নহবত
পুথি পড়া তো ভুলেই গেছি। ফিরছি খুঁজে সাঁকো
যেখানে যাই, এসেই নদী আগলে রাখে পথ।
সূর্যমুখী রেলগাড়িটা অস্তগামী হল
আঙুল-তটে জমতে থাকে বেদনাঘন তিল
মহীরুহ কি বিলাপ– তার বয়স আজো ষোলো?
আলোরা পোষে অচেনা নীল ভগ্নাংশে চিল।
লেখাগুলো তারিয়ে তারিয়ে পড়লাম। অসাধারণ সব,ভাবিয়ে তোলার মতো। নতুন আর নতুন।
ReplyDeleteআন্তরিক ধন্যবাদ। অনেক-অনেক কৃতজ্ঞতা ও শুভেচ্ছা অবিরল। খুবখুব ভালো থাকবেন।
Delete