মহম্মদ আফজলের কবিতা

 


মহম্মদ আফজল,জন্ম ১৯৯৪ সালের ২৮ শে মার্চ,পুরুলিয়া-ঝাড়খন্ড সীমান্তবর্তী এক প্রত্যন্ত গ্রামে থাকেন,যেখানে বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হল নৌকা। কৈশোরে পিতৃবিয়োগ হয় তরুণ এই কবির। তাই সংসারের বোঝা মাথায় নিতে অল্প বয়সেই পৈতৃক কাপড়ের দোকানে বসেন। কিন্তু কবিত্ব তাঁর রক্তে,তিনি স্বভাবকবি,তাই দোকানে খরিদ্দার সামলানোর পাশাপাশি ফাঁক পেলেই কবিতার খাতা নিয়ে বসে পড়েন।৷ এলাকায় সাঁওতাল ও নিম্ন বর্গের হিন্দু জনজাতির বাস,তাঁরা উচ্চমাধ্যমিকের পর যোগাযোগ না থাকার জন্য কলেজে যেতে পারে না,বিশেষ করে মেয়েরা,নারী শিক্ষা সচেতন এই কবি এলাকার নদীতে সেতুর জন্যও আন্দোলন করেন। পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম যেখানে সাহিত্য চর্চা প্রায় নেই বললেই চলে সেখানে তিনি নিজের আলোতেই ভাস্বর হয়ে জ্বলছেন একা একা। বেশ কিছু পত্র পত্রিকায় তাঁর লেখা ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।

আজ জিরো বাউন্ডারির একক উদযাপন বিভাগে থাকছে তরুণ কবি মহম্মদ আফজলের একগুচ্ছ কবিতা। 


১: কবিতার সিক্যুয়েল



চাঁদের আলোটা আজও আগলে রেখেছে ফাঁকা চেয়ারে মাখা গন্ধটা

একদিন পুড়েছিল, পাহাড়ের এপারে নদী পেরিয়ে আসা কবিতার খেলাঘর

ছোট্ট রাস্তার ধুলোয় পায়ের ছাপগুলো একদিন ঠিক ফিরে আসবে বলেই চোখদুটো অপেক্ষায় ছিল

একদিন কাঁদতে হবে এ কথাটা ঝর্ণা জানতো,

তার জানা ছিল রঙ মেখে রঙিন হয়েও বিবর্ণতার ইতিকথা 

শিখর বেয়ে নদীর টানে সমুদ্রে মেশার কথা,তার জানা ছিল-

অরব স্বপ্নের খাঁচায় দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা।

সম্পর্কের প্রচ্ছদে তামাটে রঙের ধোঁয়াশাকে খাঁটি সোনা ভেবে আঙুলগুলো বড়ই ক্লান্ত।

কবিতা হয়তো বেঁচে থাকে,জীবন্ত সূর্যের মতো আকাশের সিলিংয়ে পুড়তে পুড়তে

আগুন,শুধু আগুনগুলো ছাই হয়ে হারিয়ে যায় আর পড়ে থাকে দাগ

হৃৎপিণ্ড আহত হয়;

এখানে নিরব রক্তক্ষরণের নাম প্রমিথিউসের দণ্ড ।



২: ব্লাডপ্রেসার


লালচোখ আর ছোটকরে কাটা আধপাকা চুল,

লাল সমুদ্র? এখন বাঁ হাতের মুঠোয়। 

অহরহ শুধু দীর্ঘশ্বাসের শব্দ এই ফাঁকা ঘরগুলোই চেনে, 

কখনো বেজে আসে দূরের স্মৃতি খোলা জানালার পথ ধরে।

বাতাসের ড্রয়িংরুম আর আমি এখন একডোরে বাঁধা।

বদনাম ছড়ানো সেই তবলার টান

মাশুকের স্কন্ধে মালিকানা এখন তল্পির বুকে ক্যাকটাস। 

বোবা ঘড়িটা সময় পার করে ধার শোধ করে এসেছে।

চেয়ারের চোয়ালে এখন নাটক হয় না।

টেবিলের আধঝোলা পেপার,হারানো কলমের ছিপি নিজের যুগ্মতার চাকচিক্যে ব্যাপ্ত ।

প্রণয় এখন জিয়ারতের চুমুক দিতে দিতে নতুন গন্ধে ডুবে আছে।

নেশাগ্রস্থ কলহাস্তরিতা সুদূরে নতুন ঠোঁটে ছবি আঁকে।

মজ্জার মডেলে এখন ধোঁয়ার রিসাইকেল চলছে।

তাজমহলের গায়ে আলেখা বেদনার সুর পর্যটকের ডালি ভরাতে পারেনি।

ডলারের পথ পুব আকাশে গুলদস্তার জানাজা দেখায়-

কারণ ব্লাডপ্রেসার রোগী শেরপা হতে পারে না।



৩: দুঃস্বপ্নে জেগে থাকা প্রেম


শব্দের  সমুদ্রে ডুবে কবিতার ঝিনুক সন্ধানে নিজের পরিচয় পাওয়ার ইচ্ছে নিয়ে-

তোমার হাত ধরেছিলাম

ভাবতেই পারিনি কখন মাটির দেয়ালে বন্যা নেমেছে

আমার ইচ্ছের বালিশে আগামীর স্বপ্নহীন ঘুমগুলো এখনো অসম্পূর্ণ।

প্রবল জ্বরে গা ঘেমে উঠে

জ্ঞানের পিণ্ডে দধিচির কুঠারাঘাত,

ভীষণ, আরো ভীষণ দারিদ্র্য যন্ত্রণার ব্যাপ্তার্থ।

দীর্ঘনিঃশ্বাসের পরিধির ওপারে-

মৃত ফোয়ারা সিন্ধুর অলীক স্বপ্নে লীন।

ছায়ারা প্রাণ পাওয়ার স্পৃহায় বৃষ্টিপ্রেমী চাতক হয়ে

খরতার নীলাকাশে ক্লান্তির ডানা ঝাপটায়।

নিষ্প্রাণ চেতনার অন্ধকার রাজ্যের প্রহরীরা তাণ্ডব চালায়।

প্রথিত আর যশহীন স্বপ্নের পদতলে সমর্পিত প্রাণ

বিনয়ী সুরের মূর্ছনায় বিলীন।

এখন তো বাস্তবের ছক কাটা নিয়মের বাইরে চলাই জীবন

উজ্জ্বল নক্ষত্রের ছায়াতলে অস্পৃশ্য অক্ষর নিয়ে 

নির্জীব অনুভবেরা লম্বা সারির পিছনে অপেক্ষারত।

শেষ প্রয়াসে যদি স্বপ্নগুলো পূরণ হয়? জানি, ভাবটাই ব্যর্থ!

সুকান্ত'র চাঁদ খিদে মেটাতে পারে না

দারিদ্র্যতার সুখ মানেই অ্যাপেনডিক্স!


৪: ধ্রুপদী সমাজের কোলাজ


১>

ফেটে চুঁইয়ে পড়া ব্লাড গ্রুপের স্যাম্পল এনালাইসিস করার মতো মাটি পৃথিবীর বুকে কবে জন্মাবে?

ঝরঝর করে নেমে আসা কান্নার জল তো ঠিক একদিন শুকিয়ে থ হয়ে যাবে কিন্তু নোনা গন্ধের সাক্ষী কে দেবে?

২>

বাতেলাবাজের আসন থেকে টর্নেডো গতিতে সৈন্যরা ছুটে এলেও চড়া দামে বিক্রি হওয়া বধ্যভূমির প্রসাদের স্বাদ কেমন তা কেউ বলতে পারবে?


৩>

নাইট ক্লাবের পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া ব্যস্ত ইমার্জেন্সি সাইরেন কোনো ধর্ষকের গ্রেফতার করতে পেরেছিলো কি?

৪>


টুইটারে ট্রেন্ড হওয়া কেবলাকান্তের আফসোস বার্তার সঙ্গে নাগা সাধুর গাঁজা মিশিয়ে মানবতার পেস্ট্রি।

সেঁটে দেওয়ার ডিজিট্যাল নাম স্যাটিসফেক্সন দিতেই পারো।

৫>

যদি ভক্তের ভক্তি একমুখী থাকে তবে উচ্চ স্বরের ভিত্তিহীন সংলাপও একদিন ধর্মবাণী হতে পারে। 

অতীত থেকে বর্তমান সবকিছুই যদি শূন্যবাদের প্রলাপেই বিকশিত হয় তবে সত্য বলে কিছু নাই।

৬>

পুরনো অস্ত্রের গায়ে খোদাই করা ঈশ্বরের শান্তির বার্তা আর আর ধর্ষকের পকেটে কন্ডোম, দুটোর রেশিও সমান।


৬: ডাস্টবিন


অথচ এখনো অসহায় ভাবে বসে ধুঁকছি

নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে,

কালো ছায়া গ্রাস করতে শুরু করেছে,

তীব্র বেগে ধেয়ে আসছে অযাচিত মৃত্যু ।

অথচ ওরা এখনো-

জামার আধভাঙা বোতামের রহস্য খুঁজে পেল না।

আমি বলেছিলাম একটু ভাতের কথা,

নুন আর শুকনো ভাত হলেই চলবে;

তবে কি অদৃশ্য শক্তির দোহাই দিয়ে অন্ন খুঁজতে বলছো?

তোমাদের খাতায় সঞ্চিত পাপ-পুণ্যের হিসেবের অঙ্কে-

আমাদের তো পেট ভরে না। 

ধর্মের ব্যারিকেড ভাঙলেই তো মৃত্যু,

অনেকেরই দেখেছি।

তোমাদের সমাজে প্রচলিত ধর্মের বুলি-

আমাদের আর্তনাদের ভাষা বুঝতে পারেনি।

প্রত্যাশা রেখেছিল যারা তাদের লাশে মাছি বসে আছে।

অথচ তোমরাই সুখে আছো

আমি দাঁড়িয়ে তোমাদের চকচকে দেবালয়ের বাইরে।

আচ্ছা,  তোমরা তো রোজ আসো,

কি পেলে? নিশ্চয়ই সব পাও।

শুনেছি খুঁজলেই নাকি রাশি রাশি পাওয়া যায়?

আমি তো রোজ আসতাম।

কত প্রার্থনা করেছি, যদি পেট ভরে যায় !

অথচ সাড়া পাইনি।

খালি পেটে সেই ফিরে গেছি ডাস্টবিনে,

বড়দের ছুঁড়ে ফেলা উচ্ছিষ্ট খাবারই আমার পথ্য।

ডাস্টবিনটা কোনোদিন মুখ ফেরায়নি-

আমি ডাস্টবিনের মাঝে আমার ঈশ্বর খুঁজে পেয়েছি।

Comments

  1. খুব খুব ভালো লাগলো ।
    "আমি ডাস্টবিনের মাঝে আমার ঈশ্বর খুঁজে পেয়েছি।" অনন্য উচ্চারণ । জয় হোক ।


    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

শম্পা সামন্তর কবিতা

মোনালিসা রেহমানের কবিতা

বিবেকানন্দ দাসের কবিতা