এবাদুল হকের কবিতা

 

এবাদুল হক।। ভগবানগোলা।। মুর্শিদাবাদ।। জন্ম - 1960 04/ 01 

পেশা : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ।পড়াশোনা : এম এ বিএড বাংলা সাহিত্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। 

সম্পাদনা করেন দুটি পত্রিকা--  আবার এসেছি ফিরে এবং পুনশ্চ। 

আজ জিরো বাউন্ডারির একক উদযাপন বিভাগে থাকছে কবির একগুচ্ছ কবিতা। 



১:         রূপান্তরিত কাকের গদ‍্য  



শাদা কাক আর কৃষ্ণ কাক ঘিরে যত মন্তব্য ছিল থাকুক 

আমি জেনেছি এই সময় সৃষ্ট ম‍্যাজিক দণ্ড আরোপ করে 

কেউবা জেনেছেন শাদা কাকের প্ল‍্যানচেট করে নতুন নিয়মে 

দুটি তথ্য হুবহু এক না হলেও জানা গেছে কাক শাদায়।

খাণ্ডব দহনে নিহিত ছিল কৃষ্ণ আর কৌন্তয়ের শঠতা 

খাণ্ডব দহন হয়ে ছিল ঐশী বনাম মানুষ যখন ঐশী 

খাণ্ডব দহনে পুড়েছে পশুপাখি মানুষের ফুসফুস হৃৎপিণ্ড

প্রাণহরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিল তামাশা আর রগড়।

একদিন বর্ণহারা কাক তুলসী তলায় লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে 

কেবল নিজ রং অস্তিত্ব হারানো নয় বিপন্ন মানুষ স্বভাব বিস্ময় বিমূর্ত হয়ে উঠেছে বর্ণিল চরাঞ্চল সদাচঞ্চল সত‍্যরা বর্ণচোরা হয়ে মিথ্যার সাথেই করে সহবাস।আজ কাক গোটা সূর্য মুখে

 নিয়ে আমাজানে আগুন জ্বালায় দীঘির জলে ফেলে দেয় 

একটুকরো সমুদ্র জলে আর এক মৃত্তিকা ধর্ষণে

 আরেকফালি ঝরনার জলে বাকী অংশ অভিশাপ মোচন নিজ ক্ষোভে

 ঠান্ডা জল ঢেলে মেথর বিশেষ।ধর্ষিতা মাটি রাগে দুঃখে 

অপমানে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ছারখার করতে ফেটে পড়ল

 শতভাগ তপন ক্ষমতা নিয়েসারা পৃথিবীর মাটি 

বনজঙ্গলজলজ উদ্ভিদ প্রানী মানুষ অভাবে স্বভাবে শাদা কাকের 

অভিশাপে কর্তন করল নিজস্বী। কাকভূষণ্ডী আজ আর পৃথিবীতে ফেরেননি কখনও।



২:  নিহত হওয়ার অপেক্ষায়   


জানালাটা অদ্ভূত ভাবেই বন্ধ হয়ে যায় 

আর অন্ধকার ঘরের বিছানায় বসে পড়ি 

মনের আনন্দে ডানাওয়ালা মাকড়শা 

স্বপ্ন বুনে চলে জমা হয় স্বপন পাহাড়।


দরজা খুলতেই ভ‍্যাপসা গন্ধ নাকের ভিতর 

জানালা থেকে দরজা দশফুটের দূরত্ব 

নিজস্ব পচন থেকেই বুদ্ধিজীবী গন্ধ  

ঘরের ভিতরের ঘুণপোকারা বাহিরের ছোঁয়ায় 

শীতলতা পেয়ে ছুটে যায় বারান্দার মেঝেয়।


জানালা বন্ধ করে বড় ভুল করে ফেলেছি সুজন 

দরজা বন্ধ করে ছুটে যাই জানালার দেওয়াল খুঁজি 

আকাশ দেখতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠি অশনি সংকেত

ঝুলে আছে। জানালার রেলিং জাপটে মৃত- জ‍্যোৎস্না।


বৃত্তের ভিতর অর্ধেক কাকজ‍্যোৎস্না বাকিটা গাঢ় আঁধার।


কাকজ‍্যোৎস্নাবৃত্তের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠি 

আবার তাকাই আকাশভেদি কম্পন বিদ‍্যুৎ চমক 

পেছনে কাঁধ ঘোরাতেই চোখ ধাঁধিয়ে ওঠে কেন? 

মাথার ভেতর থেকে উড়ে যায় রাত জাগা পেঁচার গন্ধ।


আকাশ দেখব বলে প্রায় রাতে জানালা খুলে দিই 

আর 

নিহত হওয়ার জন্য 

দুর্ধর্ষ এক আততায়ীর অপেক্ষায় দিন গুনতে 



        ৩:       সীমারেখা সীমাহীন  



কোথায় লুকিয়ে থাকি বলো চারিদিক এত আলোময় কেন? 

চোখের সুরমা আলোর রশ্মিচ্ছটায় নিমেষে উধাও 

গাঙচিল মাথার উপরে তীক্ষ্ম নখের আঁচড়ের দাগ রেখে যায়।


স্ট্রবেরিও ওদের দলের মাথা হয়ে শাসন চালায় 

গুপ্তচর গুপ্তগুহার পথ আগলে বসে আছে প্রবেশ নিষেধ।

আমাদের সীমান্ত রেখায় কাদের জয়ধ্বনি? 

ওদের প্রবেশ প্রস্থান প্রস্তাব পাশ ইচ্ছাধীন। 

আমাদের সীমারেখা দারিদ্ররেখার চরমতম 

রেখার অধীন ; মায়াময় ছায়াময় সবখানে ভয়ের সংকেত।


শীতের দেওয়ালে উদমগায়ে আমাদের বসবাস 

পৌষমাস শীতের আদল দেখতে দেখতে বরফচাঁই 

হয়ে বরফ পাহাড়ের গায়ে কিসের গান গায় কেমনতর 

হাড়গোড় গলেগলে আনটার্টিকায় সমুদ্র হয়ে যায়।

যান্ত্রিক শবের পাহাড় গলতে থাকে। একটুকরো রুটির 

বিহনে ওরা ঠান্ডা হয় গলতে থাকে পুরুষ সৌর্যের কাছে 

মাথা নত করে। মাথার ভিতর ঘুরতে থাকে সুদর্শনচক্র। 


কান্না বাড়ে ঠাণ্ডায় হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকি দাবানল যেন 

আগুন জ্বলে ওঠে ভয়াবহ আগুন পাহাড় জ্বালায় 

যে রঙের অসভ্যতা শুরু হয়েছিল একদিন আগুনে পোড়ে 

রঙের বর্ণগুলি অগভীর থেকে ফিকে - কালো হয়ে ওঠে। 


রঙের অসুখ করেছে জেনে আমাদের ঈশ্বরগুলি 

হাতনাড়ে শব্দবন্ধে স্ত্রোস্তপাঠ করে কিম্ভূতকার অনেক 

বিষধর ছেড়ে তারা দিন গুনছে। সময়ের আতঙ্ক চারিধার

কুমন্ত্রালয়ে আগুন পাত্রমিত্র সভাসদ বোবা ও বধির আর ঈশ্বর খঞ্জর হয়ে ওঠে ফাঁসির ভয়াবহ কল্পণাও নাগাল রহিত 

বোবা ও বধির মানুষেরা বুলেট মুখে পুরে নিদান দেয় গর্জে ওঠে। 

তফাৎ যাও মিঞার দল! বামুন ছিলে ঠিকই এখন যে বামুনই থাকবে ভায়া পরিবর্তিত হাওয়া তোমার দেওয়া মূল্যবোধ বাস্কবন্দী। বাঘাইছড়ি আর কাকে দেখাবে বল?


আমাদের মাথার নীচে বালিশ এসেছে রঙিন। নীল তারা 

হাতছানি দিয়ে ডাকে। আকাশ উঁকি দেয় আমার দুয়ারে।

নিজেদের জায়গা নিজেদের খুঁজে নিতে হয় কালের প্রবাহে।

কালের শঙ্খধ্বনিতে বেজে ওঠে যে সুর তাতে সাড়া দিলেই 

বাসযোগ‍্য আস্তানায় ঠিক পৌঁছে দেবে মহাকালের মাঙ্গলিক সঙ্গীতসুর।




৪: আত্মবিশ্বাসের ঝুলিতে ঝুলছি আমি  



অনিন্দ্রাবীজ বুনেছি আমার মাথায় 

প্রিয়তম মেঘকাতর রাতে

আত্মবিশ্বাসের শক্তদড়ি 

দীর্ঘদিনের অপেক্ষায় ছিল বলেই কেবল লম্বাতর হয়।

মেঘগন্ধ - দারুচিনি - গ্রামগঞ্জ মৌনবিষাদে যেন আরও মৌনতর মোড়কে ঢাকা পড়ে আছে।

বিষাদের শরীর ফেটে বীজ বীর্য ছড়িয়ে পড়ে তামাটে মাটির উপর 

নিঝুম রাতের দেহচাষ ; অনিন্দ্রায় অবশ জেগে থাকা ; ডেকে তোলে রাতের দোয়েল।

ঘনিষ্ঠ কালো আকাশের বুক চিরে বিদ‍্যুৎ চমকায়। ভয় হয়।

ভয় পাব বলে নদীর জল কলতান করে ওঠে 

" ঘুমবীজ মাথায় বুনেছ আবার কিসের ভয়। "

আয়নারা দেখো দেখো তোমাদের মুখে কত জল!

অশ্রুবিন্দু তোমাদের কিংবা হৃদয় যন্ত্রণার ফসল বুঝি? 

আমার স্মৃতি সত্তার কান্নাগুলি তোমাদের আয়নায় বিদ্ধ 

অথচ তুমি প্রতারণা করো নিজের সাথে নিজের।

তোর্সার চিকন পাথরের উপর যৌবন জল ছলছল 

জলের নৌকায় ভেসে যায় মাটির বতর জলময় চারিদিক 

পাতারা জেনে যায় মাঠকাম দেহগন্ধ চিরল চুলের আহ্বান 

তবুও নক্ষত্রের মুখের উপর খেলা করে মেঘবতী ঢেউ 

প্রতুল আঁধার আর অন্ধকার। মাথার উপর ঘুমপাক খেলে 

রাতের ঘুঘুর অবসাদ। 


আয় পাখি আয় দেখে যা বেতবনে চাঁদ‍ের বনের শোভা 

জলের মুদ্রায় ভাসে চাঁদশরীর চাঁদমুখ তোলে ষোড়শী 

আমি দুহাতে তার দেহগন্ধ জড়াব চাঁদকমল নির্যাস।

পাহাড়ি পাতারা নেমে এলে জলে জলনৌকার জলে 

আমার বুকের জল নীরবে মেশে মানুষের বুকের গভীরে।


মানুষের বুকের খাঁচায় অনিন্দ্রার আত্মবিশ্বাস যখন থেকে

বেঁধেছে বাসা তখন থেকে শক্তরশ্মি দৃঢ় থেকে দৃঢ়তার সাথে

আমি স্পষ্টত জেনে গেছি মানুষের বিবেকযন্ত্রণা নিরুপায় কাঁদে



৫: পিপাসার জলের মতন কবিতা  



বৃত্তের ভেতর বসবাস আরেক বৃত্তের

কিশোরটি বৃত্তের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল 

তার চোখের গভীরে ছিল মহাখাদ অন্ধগহ্বর।

সুড়ঙ্গের ধারাপাতে সংকট সংকুল যাত্রাপথ

দিশাহারা বন্ধুর চোরাগলি সমুদ্র তরঙ্গ ঢেউ।


এককালে যে কিশোর চোখের ভাষায় 

রেখেছিল আগুন বুকের ভিতরে প্রত‍্যয়

শিরা ধমনি ফুলে ফেঁপে ওঠানামা ঘনঘন 

কিশোর জানত বাঁক বদল হবেই একদিন।

পিপাসার জলের চৌকিদার তার কেড়ে নিল সব  

ত্রাণ তহবিল খুলে দরদ দেখালে মানুষজন 

প্রতারিত ছিন্নভিন্ন দলছুট একান্তে প্রাচীর তুলে 

নির্বাসন দণ্ড হাতে নিয়ে বামাচারী সাগ্নিক সন্ন‍্যাসী।

কিশোর কিশোরী মদে মাংসে বিলাস বৈভবে

মেরুকরণ পতাকা হাতে দেশোদ্ধারের মাতাল 

মানুষ খুনের খেউড় খুল্লাম অষ্টাদশের কবিয়াল

মেরুদণ্ডহীন অথর্ব পঙ্গুত্ব জীবন নিয়ে সমাজতত্ত্ব গায়।

প্রতিবেশি চাঁদ শিখে নেয় বৃত্ত ভাঙার গানের মহাকলি।



  ৬: অনির্বান উত্তাপের রেখা 



কোমল লজ্জা এসে দাঁড়িয়েছিল দরজার পাশে 

অলিখিত পংক্তি থেকে চোখে পড়ে তীরবিদ্ধ পায়ের আভাস 

দেওয়ালে গিয়েছে ডুবে অনির্বাণ উত্তাপের রেখা 

নিজেকে বন্দী করে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকে একরাশ দ্বিধা 

চেয়ে দেখি দশ হাত দূরে আমার ক্ষয়িত রাত,নতমুখী রাত।

বাগানে ফেলেছে ছায়া সূর্যের গভীর থেকে এসে 

বাদামি হাসির আভা মুখে তার আকর্ণ বিস্তৃত 

শব্দহীন মধ‍্যদিনে নদীতে পাথর গড়িয়ে পড়ে 

দু'একটি ইঁদুর বিড়াল পেরিয়ে যায় ভীরু বারান্দায় 

সে নারী তাদের দেখে অসহিষ্ণু দাঁতে কাটে নখ।

দূর্বল বাহুমূল আমার বসে থাকি নিশ্চুপ 

বাগানে অর্থহীন পাতাগুলি নড়ে দিকবিদিক 

অনতিক্রম‍্য এই দশ হাত ভঙ্গুরতা, সেতুহীন স্রোত 

নিজের পোস্টার মেরে পিছন দেয়ালে দেখতে থাকি 

তোমার কামনাহীন চোখে সূর্যের ছায়ার দীঘি                যেন জেলের বিশাল গেট মধ‍্যরাতে খোলা।

সুদীর্ঘ  সুড়ঙ্গ পথে স্নেহশীল অলৌকিক আলো।

চেয়ারের আগুনে আমি পুড়ে যাই ডুবে মরি টেবিলের জলে,জামার বোতামগুলি আমাকে উন্মুক্ত করে দেয়

তবু তো স্বপ্নভেঙে  চিতার ক্ষীপ্র পথে হেঁটে যেত পারো

আমাকে দলিত করে প্রতিক্ষণ শব্দের মেঝেয় ;

যে বালিকা ছড়িয়ে দিত আমার হিরকগুলি সারা ঘরময় 

তোমার চোখের ভাষা তার মতো স্বচ্ছ নয় কেন।

কেন তুমি এমন কামনাহীন, কেন তুমি এত মেঘের মতো আলিঙ্গন প্রিয় 

নির্মম লজ্জা এসে দাঁড়িয়েছিল দরজার পাশে 

মনে পড়ে একদিন একটি জলের রেখা পার হতে কেঁদেছিলাম আমি 

স্বয়মাগতার কাছে কোন পথে যেতে হয় জানিনা আজিও।

Comments

  1. এ কবিতায় মন্তব্য করার মত যোগ্যতা আমার নেই,তবে উপলব্ধি হল-বেশ জটিল,শব্দের ভিতরে অনেক শব্দ লুকানো ,মানুষ হবার জন্য কবিতাগুলো পড়ার খুবই দরকার ছিল।শুধু আমার নয় অনেকেরই!

    ReplyDelete
  2. এবাদুল হক ভাইয়ের কবিতা সবসময়ই অন্যরকম দ্যোতনা সৃষ্টি করে, দারুণ সব কবিতা...

    ReplyDelete
  3. এবাদুল হক ভাইয়ের কবিতা সবসময়ই অন্যরকম দ্যোতনা সৃষ্টি করে, দারুণ সব কবিতা...

    ReplyDelete
  4. এবাদুল হক ভাইয়ের কবিতা সবসময়ই অন্যরকম দ্যোতনা সৃষ্টি করে, দারুণ সব কবিতা...

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

শম্পা সামন্তর কবিতা

মোনালিসা রেহমানের কবিতা

বিবেকানন্দ দাসের কবিতা