দেবানন্দ ভট্টাচার্যের কবিতা
![]() |
দেবানন্দ ভট্টাচার্য। জন্ম কলকাতায়। উনিশশো তিপ্পান্ন
সালে। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।
সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি একজন আঁকিয়ে।'নির্বাচিত কবিতা' সহ মুদ্রিত বই তিনটি।
আজ জিরো বাউন্ডারির একক উদযাপন বিভাগে থাকছে কবি দেবানন্দ ভট্টাচার্যের একগুচ্ছ কবিতা।
১। সাক্ষাৎকার
সমুদ্রসফর শেষে আপনার
প্রথম সাক্ষাৎকারে আমি-ই
ছিলাম। নির্ধারিত সময়ের
মধ্যে কথা শেষ করলেন।
খুব বেশি বলার সুযোগ
ছিল না আমার।
অথচ সমুদ্র নিয়ে অসীম জিজ্ঞাসা।
আপনি সময় বেঁধে দিয়েছিলেন।
সাগরের নুনজল আর
নোনা হাওয়ায় ঘুরে গায়ে
রং তো কালো হবার কথা----
অথচ আপনার রং চটেনি
চোখের কোলে নীলচে আভা
তরঙ্গভঙ্গিল !
আগের মতো সে-ই অসহিষ্ণু চাউনি
আর নেই বরং স্নিগ্ধ মায়াবী দৃষ্টি !
সিন্ধুপাখির ডানার গন্ধ পেলাম।
আপনি কি সমুদ্রের ফেনা থেকে নুন
আলাদা করা শিখেছেন ?
জিজ্ঞাসা করা সম্ভব হয়নি
২। জলমগ্নতা
ধীরে ধীরে জলের নিচে তলিয়ে
গেলাম। বুকের ওপর জল।
তারপর শূন্যতা। মেঘ রোদ্দুর ও
আকাশ। পিঠের নিচে পলি
কাদা। পাথুরে কাঁকর আর নুড়ি।
সাঁতরে বেড়াচ্ছে জলের মাছ।
সন্দেহবশত আমার চোখের খুব
কাছে এসে গন্ধ শুঁকে চলেও
যাচ্ছে। কত রকমের জলপোকা!
নানারঙের জোনাকির মতো।
জলের নিচে ঝোপঝাড়। দুলছে
জলীয় সুরে। ছেলেবেলায়
যেমন দুলে দুলে নামতা পড়তাম,
ওরকম-ই। সম্ভবত বৃষ্টি নামলো।
অসংখ্য স্বয়ংক্রিয় জলবৃত্ত
ছেয়ে যাচ্ছে। যেন জলের
আলপনা ! আমি এই আচ্ছাদনের
গভীরে নিশ্চিন্তে তলিয়ে রয়েছি।
জলের ফোঁটা। একতারার
সুরেলা ঝঙ্কার।
আমি কি কোন বাউল গানে মজে
ছিলাম ! দেহাতীতবোধ বলে
কিছু হয় নাকি? না।
এইভাবে কিছুক্ষণ জলমগ্ন ছিলাম!
৩। দেয়ালঘড়ি এবং মির্জা
মির্জা গালিবের নির্মোহ সুরাপাত্র
অনিঃশেষ নয়।
কবিতায় অসংখ্য ছত্রাক
সাদাকালো দাগ বুনে যায়।
শেষরাতে নেশাগ্রস্ত গেলাসে ভিড়
করে অন্ধকার।
দেয়াল থেকে খসে পড়ে
টিকটিকি।
বিতোভেন একা একা বাজিয়ে
চলেছেন কালজয়ী সুরধ্বনি!
এ বাড়ির পুরনো দেয়াল-ঘড়িটা
বাতিল হয়ে যায় নি।
ঠিক ঠিক চলছে চক্রাকারে
এবং নিয়মানুসারে বরাদ্দ
ঢং ঢং ঢং ঢং ..... ঢং
তবে দুর্যোগের খবর-ই রাখে না।
৪। দৃশ্যান্তরে
ওকে দেখে মনে হয় বাজপোড়া গাছ!
কবে যেন এক দিন বাজ পড়েছিল।
রোদ্দুরও অঙ্গার ছাই!
আমি ওর গান শুনেছি। নখ রাঙা
সুরঞ্জনীরাগে!----স্বর্ণচাঁপা প্রিয় ফুল।
দেখতাম প্রায়শই
ধোঁয়া ধোঁয়া দৃশ্যান্তরে হেঁটে যেতে।
যথেষ্ট রোদ্দুর দরকার ছিল। কেন যে
বঞ্চিত............. জানিনা, জানিনা।
৫। উড়ান পাখিরা
ধাতব অন্ধকার থেকে উড়ে এল
একঝাঁক হলুদ প্রজাপতি
সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি।
তিনটি ভিন্ন তিনরঙা পাখি নির্দ্বিধায়
ডানা মেলে দিল। ওরা ছিল তোমার
কোমল স্বভাবের অভ্যন্তরে
নীল পর্যায়ের।
ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে, আমিই বা
কেন ধরে রাখি উড়ান পাখিদের!
পড়ে রইলো জল-ছোলা
দাঁড় ও খাঁচা। আমিও কি পদে পদে
শিকলের শব্দ শুনি না ?
৬। প্রতিমূর্তি
পুরনো কাঠামো। খড়মাটি কবেই
খসেছে। জরাজীর্ণ কাঠের কঙ্কাল।
আমাকে পুনর্নির্মাণের কথা বলা
হল। অবিকল আগের মতো নয়,
সম্পূর্ণ নতুন মূর্তি চাই।
দিন রাত এক করে কাজ শেষ
হল। কেউ কেউ ভালো বললেন
বটে, তবে অধিকাংশই বিরূপ।
যেহেতু এমন একটা মুখ ও শরীর
ওরা কেন আমিও তো দেখিনি ও
ভাবিনি কোন কালে!
বিশেষজ্ঞরা বললেন, এই মূর্তি হুবহু
নিয়ানডার্থাল মানুষের মতো দেখতে।
একলক্ষ বছর আগেকার জীবাশ্ম
মিলেছে নিরিবিলি গুহায়। তুষারযুগে
এরা গুহাবন্দী হয়ে নিজেদের বাঁচাতে
পেরেছিল। তাই ক্রমবিবর্তিত
এদের রূপ ও জীবন-প্রণালী। এই
সব-ই নিবিড় ইতিহাসের কথা। এমন
একটা অকল্পনীয় প্রতিরূপ.......
ঘোরের মধ্যে আছি----কার্যকারণের
সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছি না।
তবে এ কথাও ঠিক, মানুষের পরবর্তী
রহস্যটা যে কী----এই তথ্য সামনে
আসে নি। গবেষণা কি থমকে আছে?
৭। এই দিন এমন থাকবে না
অকেজো অলস পা দুটো
গুটিয়ে বসুন তো। দেখতে মোটেই
ভালো লাগছে না।
এই প্রচন্ড গরমের মধ্যে ভেবে
ছিলাম রাস্তায় কেউ নামবেই না।
আমার অনুমান ভুল। পরবের ঢাক
বাজতেই মাঠভর্তি লোক।
গল্পের শেষে একটা জুতসই মোচড়
থাকবেই। যেন উল্টোরথের পালা।
কথায় কথায় রবিঠাকুরের
রথের রশি--- মনে পড়ে গেল। আজ
আবার রথযাত্রা কিনা।
বেল পাকলে কাকের কী? ভাবুন।
ভাবতে থাকুন। আমি বলি সবুর করা
ভালো। দেখা হোক, কোথাকার জল
কোথায় দাঁড়ায়!
সবুরেই তো মেওয়া ফলে শুনেছি।
Comments
Post a Comment