বিবেকানন্দ দাসের কবিতা
ইদানীং দীর্ঘ কবিতা খুব বেশি কেউ লিখতে চায় না । হয়তো পাঠকের দীর্ঘ কবিতা পড়ার প্রতি মনোযোগ কম থাকে অথবা কবির-ই অনীহা লিখতে । তবু এরই মধ্যে কেউ কেউ লিখছেন বা চেষ্টা করছেন ।
বিবেকানন্দ দাস। বাড়ি নদীয়া জেলার বড়জাগুলিয়াতে। বর্তমানে তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীন চাকুরীরত। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 5 টি। নিয়মিত কাব্যচর্চা ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সামাজিক কাজে লিপ্ত আছেন।
আজ জিরো বাউন্ডারির একক উদযাপন বিভাগে থাকছে তাঁর দুটি দীর্ঘ কবিতা ।
১ : একটি ধর্ষন ও তারপর
বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত সারণীর পথ ধরে-
ছিঁড়ছে সমস্ত বাঁধন, পুড়ছে সময়-!
ছাদের কার্নিশে শিশিরসিক্ত জ্যোৎস্নায়- কে দুফালি কাপড় শোকায়-,
মাঝরাতে স্নানঘরে সাবানের ফেনা-
হাতফস্কে সাবান দোটানায়-!
শ্যাম্পুতে ভোরের গন্ধ- শিউলি কোথায় গেলে-?
আমি অনেকটা পথ হাঁটতে চেয়েছি--,
এত রক্ত দেখিনিতো আগে-!
হাত-মুখ ধুয়ে নাও- কুঁচকি ও গোড়ালি--
শাওয়ার থেকে কি ঝরছে বুকে-!
আমি অনেক অনেক দুরে যাবো- সেজেগুজে-,
হুলুস্থুল কান্ডকারখানা-,
ছেড়া গামছার কোনে গিঁট বেঁধে
সময় থমকে দাঁড়িয়েছিলো- ঘরের কোনায়-
কিছুকি পড়লো মনে- কিছুকি হারালো-!
আহা, শার্টের বোতাম নেই কখানা-!
ওঠো, উঠে বোসো, চোখে পড়েনা-
আজীবন হাঁ-করা সুচের শিকড়ের ফুটোখানা-!
বড় তীব্র হাঁ-মুখ- ছেঁড়া ফাটা জোড়ার বাসনা,
কে ঢাকবে এ বুক-! লাগাবে বোতাম কখানা-!
আঃহ্, ছেড়ে দাও, বুকে ফুটে যাবে-
চিরুনিটা সরাও দুরে- পরিপাটি আভিজাত্য দুরে থাক,
বাঁধবো না, আমি বাঁধবো না চুল-
ঝাঁকড়া এ সংসারে- কে খেলা করে-!
নতুন হবেকি কিছু- নতুন কাপড়, নতুন জীবন,
গাড়ি- বাড়ি- সমাজ- সভ্যতা-!
ধ্যাত, ওসব প্লাস্টিকের---!
মার্ক্সের পড়ে কি- প্রাগৈতিহাসিক!
হেরেডোটাস- মিথ্যে বোলোনা--;
আমি জলদস্যু হব-! আহা- কতবড় মাস্তুল-!
আহা, স্টিমারের রঙ, কয়লার ইঞ্জিনের ধোঁয়া
কতকাল দেখিনি-!
কোথায় হারালো-! সভ্যতার ছোঁয়া-?
লাল লিপস্টিক, আইব্রো, নেলপালিশ, মাসকারা-
ও মেয়েটা পড়তো আমারি পাড়ার স্কুলে-
বক্ষ যার টানটান- উদর নক্ষত্রধুলিময়-!
মস্তবড় প্রেম, প্রেমে আটখানা, লেপ্টেথাকা চেতনা-!
কোথায় হারালো- কোথায় হারালো-!
উদ্দীপ্ত যৌবন, আঙুনরাঙা পাখি, কোকিলের ডিম- কাকের বিছানা-!
ঠিক ওইখানে বিছানার দুকোনায়-
দুটো জলজ্যান্ত লাশ- মাঝখানে বিচ্ছিন্ন সময়-!
টেনোনা- আমায় টেনোনা-
আমি আর খোকা হবোনা-
স্কুলব্যাগ, টিফিনবাক্স, ফ্লাস্ক, রঙপেন্সিল-আর বইবো না-!
স্কুল বাসটা আর কেনো আসেনা-?
আহা, টুকটুকে লাল শাড়ি, "ও মা ধার দিয়ে চলো"
আজকে দুটো চুমু চাই, নাহলে স্কুলে যাবোনা-
আমি যাবোনা- যাবোনা--!
আমি শোবোনা ও বেলাভূমিতে-
চাঁদের আলোয় কাঁটাগুলো তড়বড়িয়ে ওঠে,
বড় ব্যথা লাগে-!
এতো সুতো দিয়ে কে বেঁধেছে গোলাপস্তবক-!
এত ফুল সাজিয়েছে কেনো?
আমি শোবোনা ওইখানে-
একদিন ওইখানে আমার পৈতা হারিয়েছিলো,
হারিয়েছিলো আংটি- সিগারেটের প্যাকেট-!
আহা, স্টিমের জাহাজ, কারখানার ধোঁয়া-
কেনো আজ চোখে পড়েনা-!
অবনি, ধান লাগিয়েছো বুঝি-
কত বিঘা চাষ করেছো বেনো জলে?
শিল্প হোলোনা- চাষ হোলোনা- বিপ্লব হোলোনা-
গাছে গাছে আফিম ধরেছে, গ্যাঁজা পাতা-
সুরি- বেশ্যাখানা- ধর্ষণকারী-!
"ও মা ধার দিয়ে চলো"-
ও মেয়েটা হারিয়েছিলো এই রাস্তায়-
কত রক্ত তার- চাপ চাপ আঁন্ধার-!
কোথায় হারালো-! আর দেখা হোলোনা-!
কতদিন হোলো - ক বছর- কত মাস-?
সময় কতোটা-? কটা বাজে-?
টিকটিক আওয়াজে- সময়গুলো কোথায় হারায়-!
এখন কি ট্রেন আছে কোনো-
কোনো ট্রাম- বাস-?
আকাশে কিসের শব্দ- এতো আলো-!
কি পুড়েছে- কি পুড়ে গেলো-!
আহা, বিয়ে বাড়ি--! পুড়ছে আতস-
পুড়ছে সময়- মাধবীলতা- মৃগনাভী, মৃগশিরা, কস্তূরী-!
ছিঁড়ছে বাঁধন- বাঁধন- জোড়ে আর ছেঁড়ে-!
পুড়ুক গে-! আমি হেঁটেই চলে যাবো-
নদীর পথ বেয়ে--
এ নদীটা কোথায় যায় যেনো-!
" ও মা, আমি ধার ঘেঁসে যাবো--
ডুববো না কখনো-"!
২ : বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক
আজকাল সন্ধ্যার কিছু পরেই
আমি সত্যাদর্শী হয়ে যাই...
আমার তূণে উঠে আসে "ব" কার, "চ" কার, "গ" কারের
ধারালো কিছু অস্ত্র...
আজকাল সন্ধ্যার কিছু পরেই আমি দেখতে পাই
সারা গলি, সড়ক, মহল্লা ভরে গেছে
মৃতদেহ আর হাড়গোড়ে...
আর সাধারণ মানুষগুলো সহসা রূপান্তরিত হয়েছে
ব্রয়লার মুরগীতে,
কিছু মানুষ সেই মুরগীগুলোকে ধরে
পরম আহ্লাদে ক্যাচাৎ করে গলা কাটছে,
মুরগীর মাংস হ'তে তৈরী হচ্ছে কিমা, রোস্ট, কাবাব...
একদল মধ্যভোজী লোক মুরগীগুলোর নাড়িভুঁড়ি
ডানা আর পায়ের অংশ নিয়ে নিজেদের মধ্যে
মারপিট করছে....
আমি কিছু "ব" কার অস্ত্র ছুঁড়ে দেই ওদের দিকে ।
সন্ধ্যার কিছু পরেই আমি সত্যাদর্শী হয়ে যাই,
কেনো জানিনা, নিজেকে নিঃসঙ্গতম লাগে...
সন্ধ্যার পর আমি দেখতে পাই মানুষগুলোর
মুখের ভিতরে চকচক করছে শ্বদন্ত ,
আস্তিনের নিচে লুকানো আছে বাঘনখ ...
যে লোকটা কে সব চেয়ে সৎ, সমাজসেবী, মনুষ্যদরদী
ভাবতাম, সেই লোকটাকেই দেখি সব চেয়ে
বেশী মিথ্যেবাদী ,ধান্দাবাজ, অসৎ ....
যেই লোকটাকে ভাবতাম সুখী
সেই লোকটাই শহরের রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করে বেড়াচ্ছে
অমিয় দুঃখ, ব্যথাদের...
সন্ধ্যার কিছু পরেই আমি দেখি -
অনন্যার গা থেকে খসে পড়ছে লাবণ্য, কমনীয়তা,
মোহমুগ্ধতা, সে খুব সাধারণ এক নারী হয়ে
ঘুরে বেড়াচ্ছে বন্ধ কারখানার দুয়ারে দুয়ারে...
আমি চিৎকার করে তাকে ডাকি,
ও কোনো উত্তর দেয়না, আমি বুঝি -
একটা প্রেমের থেকে একটা জীবনের মূল্য ওর কাছে
অনেক বেশী, আমি একটা "গ" কার অস্ত্র ছুঁড়ে দিই
জীবনের দিকে...
আমি দেখতে পাই সন্ধ্যার কিছু পরেই
একলাখ কবিদের আসরে ঘরের এককোনে
খাতা কলম নিয়ে বসে আছে আফজল আলী,
সে করছে বর্গমূলের অঙ্ক, যোগ বিয়োগ গুন ভাগ,
একটাও অঙ্ক মিলছে না তার,
আমি কিছু "ম" ছুঁড়ে দিই ওর দিকে...
সন্ধ্যার কিছু পরেই আমার মনে পড়ে
কিছু লোক বলেছিলো - এবার একটা বিপ্লবের দরকার,
সেই লোকগুলো কবে চলে গেছে কবরে, শ্মশানে..
তাদের সন্তানসন্ততীরা বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে এসে
এখন আকাশচুম্বী প্রাসাদ গড়েছে ক্যাপিটালের উপরে
বিপ্লবের ধারনা ক্রমশ হয়ে এসেছে ফিকে,
অথচ, মোহসান আলী এখনো বিশ্বাস করে -
একদিন বিপ্লব হবেই ...
মোহসান আলী পার্টি ইউনিটির আন্ডারগ্রাউন্ড যোদ্ধা ছিলো,
বিহারে জনযুদ্ধে একটি পা হারিয়ে ফিরে এসেছে
দেশের বাড়িতে, সেখানেই মিলেছে গৃহশ্রীর
একটি নীল শাদা বাড়ি, বিপিএল হিসাবে পায়
বিনিপয়সার রেশন...
তবুও সে বিশ্বাস রাখে বিপ্লবে ....
সন্ধ্যার কিছু পরেই মোহসান আলি ক্রাচ নিয়ে
এসে বসে আমার পাশেই...
আমি স্পষ্ট দেখতে পাই তার ভিতরে দোমড়ানো
পরাজিত একটা মানুষ ,
আমার পায়ের কাছে গড়াগড়ি খায় সোভিয়েত ইউনিয়ন,
চীন, আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্য , অস্ট্রেলিয়া ,ব্রিটেন, ফ্রান্স
আমি তাদের লাথি দিয়ে সরিয়ে বলে উঠি-
-"হেইল হিটলার..."
মোহসান আলী হেসে উঠে মন খোলা হাসিতে
বলে - "দেখো কবি, বিপ্লব একদিন হবেই",
আমি তার বিশ্বাসকে আঘাত করতে চাইনা,
অবশিষ্ট কিছু "ব" কার, "চ" কার এদিক ওদিক ছুঁড়ে
আমি শেষ পেগ গলায় ঢালতে ঢালতে
চিৎকার করে উঠি - "বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক.....!"
Comments
Post a Comment